নিউ ইয়র্ক মেইল ডেস্ক: রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং সংবিধান স্থগিতের কারণে তাকে দোষি সাব্যাস্ত করেন আদালত। রায়ের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে সেনাপ্রধান দাবি করেন, ‘মামলায় যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও পাননি মোশাররফ।’
মোশাররফ বর্তমানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে রয়েছেন। সেখান থেকে এক ভিডিওবার্তায় তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন। ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর অবৈধভাবে সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম বেসামরিক আদালতে দেশদ্রোহের অভিযোগে কোনো সাবেক সেনাপ্রধানের বিচারের রায় এলো।
পেশোয়ার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াকার আহমাদ শেঠ নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের বিশেষ আদালত মঙ্গলবার ছয় বছর ধরে ঝুলে থাকা এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। এর মধ্যে দুজন বিচারকের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় মোশাররফের। তবে এর বিরুদ্ধে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সুযোগ পাবেন তিনি। সেখানে যদি রায় বহাল থাকে তাহলে তাঁর সামনে শুধু প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে।
রায়ের পর সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল আসিফ গফুর এক বিবৃতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন, ‘বিশেষ আদালতের এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ব্যথাতুর হৃদয়ে এবং মনস্তাপের সঙ্গে গ্রহণ করেছে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী।’ তিনি আরো বলেন, ‘একজন সাবেক সেনাপ্রধান, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, যিনি ৪০ বছর দেশসেবা করেছেন, দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন, তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী হতে পারেন না। বিশেষ আদালতের এই মামলায় যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হয়নি। তাড়াহুড়া করে মামলা শেষ করা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশা করে দেশের সংবিধান অনুসারে এই মামলার বিচার হবে।’
১৯৯৯ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের পর ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোশাররফ। পরে ২০১৩ সালে নওয়াজ ফের দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে মোশাররফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের এই মামলা করা হয়। বিশেষ আদালত ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় মোশাররফকে অভিযুক্ত করে বিচার শুরু করে। কিন্তু পরে বিচারের কাজ ঝুলে যায়। ওই অবস্থায় ২০১৬ সালের মার্চে চিকিৎসার কথা বলে দেশ ছাড়েন পাকিস্তানের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। তার পর থেকে লন্ডন ও দুবাইয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন তিনি।
দুবাইয়ের এক হাসপাতাল থেকে গতকাল ৭৬ বছর বয়সী এই সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি ১০ বছর দেশের (প্রেসিডেন্টের) দায়িত্ব পালন করেছি। দেশের জন্য লড়াই করেছি। এই মামলায় আমার বক্তব্যও শোনা হয়নি, অথচ আমাকে দোষী বানানো হয়েছে।’ মামলা শুরুর পর মাত্র দুটি শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন মোশাররফ। তার পর থেকেই তিনি দেশের বাইরে। মামলা দায়ের হওয়ার সময় একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যায়িত করে মোশাররফ আরো বলেন, ২০০৭ সালে সংবিধান স্থগিত ও জরুরি অবস্থা জারির যে নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন, তাতে সরকার ও মন্ত্রিসভার সায় ছিল। তবে ওই যুক্তি খারিজ করে দিয়ে আদালত রায়ে বলেছেন, সংবিধান স্থগিতের সেই পদক্ষেপ ছিল অবৈধ ও রাষ্ট্রবিরোধী।
মোশাররফ ক্ষমতায় থাকাকালে মোটামুটি শান্ত সময় পার করলেও ২০০৭ সালে প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করলে তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। তিনি সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করেন। পরের বছর শুরুর দিকে নির্বাচনের ডাক দেন। এর মধ্যেই নির্বাচনী এক জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে নিহত হন বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেত্রী বেনজির ভুট্টো। আন্দোলন আরো জোরালো হয়। মোশাররফ অভিশংসনের হুমকির মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। পাকিস্তানের একটি আদালত বেনজির হত্যা মামলায় মোশাররফকে আসামি করেছেন। গতকাল রায় হওয়ার পর বেনজিরের ছেলে এবং পিপিপি নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, ‘গণতন্ত্রই সর্বোত্তম প্রতিশোধ।’ সূত্র : বিবিসি, ডন, এএফপি।