তৃতীয় দফায় মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংলাপ কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তৃতীয়বারের মতো কথা বলতে বুধবার কক্সবাজারের এসেছেন মিয়ানমার ও আসিয়ানের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।
দুই দিনের সফরে আসা প্রতিনিধি দলটি ৪৭ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করেন।এ সময় প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নিয়ে নিজ ভূমি রাখাইনে ফিরে যেতে বারবার অনুরোধ করেন।
কিন্তু রোহিঙ্গারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, রাখাইনে পূর্ণ নাগরিকত্বসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিলেই ফিরবে, এর আগে নয়।
বুধবার ও বৃহস্পতিবার ২ দিন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক্সটেনশন-৪ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমার ও আসিয়ান প্রতিনিধি দলের প্রথম দিনের সংলাপ হয়। সংলাপে ৪১ জন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ৬ জন কমিউনিটি নারী নেত্রী অংশ নেন।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক চ্যান অ্যায়ের নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলে দেশটির পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, শ্রম ও অভিবাসন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ রয়েছেন। একইভাবে ৭ সদস্যের আসিয়ান প্রতিনিধি দলে আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাগণ রয়েছেন।
বৈঠকে অংশ নেয়া রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মুহিব উল্লাহ জানান, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি সেই পুরনো কথাগুলো বারবার বলছে। এনভিসি কার্ড নিয়ে আমরা কোনোভাবেই মিয়ানমারে ফিরব না। এ কথা বলার পরও দীর্ঘদিন পরে এসে সেই পুরনো কথা নতুন করে শুরু করছে মিয়ানমার। সংলাপে নতুনত্ব বলতে কিছুই নেই।
রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার সিরাজ আহমদ বলেন, এটি মিয়ানমারের নাটক। আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান মামলাকে ভিন্নখাতে নিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলাকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো ছাড়া আমি কিছুই দেখছি না।
আরেক রোহিঙ্গা নেতা ডা. জোবায়ের আহমদ বলেন, বৈঠকে আমরা বারবার অনুরোধ করেছি যে, আমাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া হোক। কিন্তু মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এতে করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো সুরাহা দেখছি না।
রোহিঙ্গা নারী নেত্রী জামালিদা বেগম বলেন, রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছি না মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে। তারা রাখাইনে সহিংস কোনো ঘটনা শুনতে রাজি নয়। তারা বলছে তোমরা (রোহিঙ্গারা) প্রথমে এনভিসি কার্ড নাও পরে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু এনভিসি কার্ডের মধ্যে নানা শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অতিরিক্ত সচিব শামশুদ্দোজা জানান, মিয়ানমারের ৯ সদস্যবিশিষ্ট ও আসিয়ানের ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি দুইদিনের সফরে কক্সবাজারে এসেছেন। প্রথম দিনে উখিয়ার কুতুপালং এক্সটেনশন-৪ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছেন। বৃহস্পতিবার সকালে একই স্থানে পুনরায় সংলাপ শুরুর হয়ে ২টার দিকে শেষ হয়।
এর আগে চলতি বছরের ২৭ জুলাই মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়েথর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করেন। এ সময় আসিয়ানের প্রতিনিধি দলটিও সঙ্গে ছিল। সে সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের যৌথ সংলাপে অংশ নেয়।
এ ছাড়াও ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী উইন মিয়াট আয়েথর নেতৃত্বে আরও একটি প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসেছিলেন। এবার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংলাপ (ডায়ালগ) করতে দুই দিনের সফরে তৃতীয়বারের মতো মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজারে আসে।
বৃহস্পতিবার বিকালে প্রতিনিধি দলটি ঢাকার উদ্দেশে কক্সবাজার ত্যাগ করে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনায় প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়।
একই বছর ৬ জুন নেপিদুতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমঝোতার চুক্তি হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশহিসেবে দ্বিতীয় দফা ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিন ধার্য করে ৩ হাজার ৪৫৫ রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা পাঠায় মিয়ানমার সরকার। কিন্তু কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ফিরতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়।