স্বপ্না চক্রবর্তী, ঢাকা: ধর্ষণসহ নানা নির্যাতনের অভিযোগে চলতি বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই দেশবাসীকে পীড়া দিয়েছে সৌদি ফেরত নারী শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবনের গল্প।
২০১৪ সালের জুন থেকে চলতি বছরের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ৭৪টি দেশে কাজ নিয়ে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৩ জন নারীকর্মী বিদেশ গেলেও সবচেয়ে বেশি গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে। দেশটিতে এই পাঁচ বছরে মোট নারী শ্রমিক গিয়েছেন ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৯০ জন। এদের মধ্যে ৮ হাজার কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময় দেশে ফিরলেও অমানবিক অত্যাচারে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ৫৩ জন নারী শ্রমিক। শুধু চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৮৫০ জন নারী দেশে ফিরে আসেন তাদের মুখে সেখানে যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে আসার পর বিভিন্ন নারী সংগঠনগুলো সরব হয়।
তবে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী শ্রমিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সব কিছু মিলিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী শ্রমিকদের করুণ গল্প।
দেশে ফিরে আসা নির্যাতনের শিকার নারীরা সংবাদ সম্মেলন করে নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছে তাতে শিউরে উঠতে হয়েছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকেই।
এর প্রেক্ষিতে অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো এবং নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা সৌদি আরবে নারী কর্মি পাঠানো বন্ধের দাবি তুলেছেন। জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধে সংসদ অধিবেশনে এমপিরা দাবি জানিয়েছেন। পুরুষরা প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের আয়ের ৬০ শতাংশ রেমিটেন্স পাঠালেও সেখানে নারীরা পাঠান ৯০ শতাংশ। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা এ নারী শ্রমিকদের সর্বোচ্চা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাই সব শ্রেণীর মানুষেরই।
তবে সতর্ক অবস্থায় ছিলো প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নির্যাতিত প্রবাসী নারী কর্মীদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে নানা ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে মন্ত্রণালয় দুইটি। প্রবাসে কর্মরত আর কোনো বাংলাদেশি নারী যেনো নির্যাতনের শিকার না হয়, সেজন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছে দুটি সংসদীয় কমিটি। গত ২৫ নভেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এবং ২৭ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত প্রবাসে কর্মরত নারী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এমনকি কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে সাথে সাথে পররাষ্ট্র বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাদী হয় মামলা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নারীদের নিশ্চিন্তে কাজ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন, ৮ লাখের বেশি নারী কর্মী বিদেশে আছেন। নির্যাতনের সংখ্যা যেটাই হোক তা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে পররাষ্ট্র বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বাদী হয়ে মামলা করতে বলা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, বিদেশে নারী শ্রমিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের খবরে সরকার চিন্তিত জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় সৌদি আরব দূতাবাসের শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে ডেকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সৌদি আরবে বাংলাদেশের যিনি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তাকেও নির্দেশনা দেযা হয়েছে ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি তোলার জন্য। এছাড়া দেশটিতে মহিলা কর্মী পাঠানো রিক্রুট এজেন্সিদের মধ্যে অনিয়মের কারণে ১৬০টির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। ৩টি এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে কোটি টাকার বেশি। এক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। তিনি জানান, সৌদি আরবে কর্মরত গৃহকর্মীদের অভিযোগ শুনতে অনলাইন ব্যবস্থা মুসানেদ (সহায়তা) ২০১৫ সাল থেকেই কার্যকর রয়েছে। এ ব্যবস্থায় নির্যাতিত গৃহকর্মীরা অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। পাশাপাশি ফোনেও অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত নারীরা দূতাবাসের শেল্টারহোমে অভিযোগ না করে দেশের আত্মীয়দের কাছে অত্যাচারের কথা বলেন। তবে অভিযোগ যেখান থেকে করা হোক, সব অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি আমরা। একইসঙ্গে নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।
নির্যাতিত নারী শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, এক হাজার রিয়েল বেতনের কথা বলে নিয়ে গেলেও কিন্তু ৭০০ বা ৮০০ রিয়েল বেতন দেয়, যা বাংলাদেশি ১৫ হাজার টাকার সমান হবে। অনেক ক্ষেত্রে বেতনই দেয়না এবং বেতন চাইলেই নির্যাতন বেড় যায়। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর তানিয়া সৌদি আরবে যেখানে কাজ করতেন সেখানে পিটিয়ে তার পা ভেঙে দেয়া হয়। গত ১৫ নভেম্বর সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসা গৃহকর্মী সুমি আক্তারকে তার বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অষ্টম শ্রেণি পাশ করা সুমি দুইবছর আগে ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে যোগ দেন। সাংবাদিকদের তিনি জানান, সেখানেই নুরুল ইসলাম নামের আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ঢাকায় যাওয়ার ছয় মাস পর তাকেই বিয়ে করেন সুমি। গত ৩০ মে স্বামী নুরুল ইসলাম ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’ নামের এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে গৃহকর্মী ভিসায় সৌদি আরবের রিয়াদে পাঠান। সেখানে যাওয়ার পর প্রথম কর্মস্থলে মালিক তাকে মারধর, হাতের তালুতে গরম তেল ঢেলে দেওয়া এবং কক্ষে আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতেন। একপর্যায়ে সুমি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন ওই মালিক তাকে না জানিয়ে ইয়েমেন সীমান্ত এলাকা নাজরানের এক ব্যক্তির কাছে প্রায় ২২ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে দেন। ওই মালিকও তাকে নির্যাতন করতেন। উদ্ধার হওয়ার আগে ১৫দিন তাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয়নি। তার নিজের মুঠোফোনটিও তারা নিয়ে নিয়েছিল। এক সময় খুব কান্নাকাটি করে স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য মোবাইলটি চেয়ে নেন তিনি। তারা মোবাইলটি দিলে, বাথরুমে গিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন। সেই ভিডিওতে নিজের নির্যাতনের কথা বর্ণনা দেন তিনি। ভিডিওটি সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই ভিডিওটি সুমির স্বামী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সুমিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি কনস্যুলেট আব্দুল হক সৌদি পুলিশের সহযোগিতায় সুমিকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, নির্যাতনের যেসব অভিযোগ আসছে, সেই প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মী পাঠানো কমিয়ে দেয়ার বিষয়ে সরকার আলোচনা করছে। মহিলারা যারা ফেরত আসছেন, শোনা যাচ্ছে, তারা সেখানে নির্যাতিত হয়েছেন। আমরা এটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন এবং যথেষ্ট সজাগ। সেই জন্য আমরা আমাদের মিশনে ২৪ ঘন্টার হট লাইন চালু করেছি। নির্যাতিত মহিলা যারই খবর পাওয়া যায়, তার জন্য আমরা শেল্টার তৈরি করেছি। এমন নারীদের উদ্ধার করে সরকারি পয়সায় আমরা তাদের প্রথমে ঐ শেল্টারহোমে রাখছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরও বলেন, সরকার এনিয়ে আলোচনা করছে যে কি করা যায়। বাসাবাড়িতে যারা কাজ নিয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যাটা খুব প্রকট। সেজন্য আমরা চিন্তা ভাবনা করছি, বাসা বাড়িতে পাঠানো কমিয়ে দেয়া যায় কিনা। এখনও চূন্তান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেননি। তবে এ বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা করছেন এবং আলোচনায় একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।