উম্মে সালমা থাকেন রাজধানীর বছিলার ৩৩ নং ওয়ার্ড এলাকায়। শহরের বাইরে একটু নিরিবিলি বসবাসের আশায় কিছুদিন আগেই বাসা ভাড়া নেওয়া সালমার কণ্ঠে স্বস্থির চাইতে আক্ষেপই বেশি।
তিনি জানান, ডিসেম্বর এক তারিখে বাসায় উঠেছি। প্রথম প্রথম সবই ঠিকঠাকা ছিলো। কিন্তু যেই একটু শীত পড়তে শুরু করলো দেখা দিলো সংকট। এ সংকটের নাম গ্যাস সংকট। সকাল ৯ টার সময় নিয়ম করে গ্যাসের চাপ কমে যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা নেমে আসে শূণ্যের কোটায়। কখনো কখনো বিকাল ৩ টার পর চাপ বাড়লেও বেশিরভাগ সময়ই রাত ১০ টা পর্যন্ত রান্না করার উপযোগী গ্যাস পাওয়া যায় না। এতে করে দুইজনের সংসারেও পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। রান্না করতে না পেরে অনেক সময়ই খেতে হচ্ছে রেস্তোরার খাবার।
অভিযোগ আছে মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনে এখনো চলছে রাজধানীর ঢাকায় গ্যাস সরবাহ। এতে করে সংযোগ লাইনে লিকেজসহ ঘটছে বড় ধরণের দুর্ঘটনা। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনের কারণেই গ্যাসের সঞ্চালনেও বিঘ্ন ঘটছে বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এর থেকে উত্তরণে সারাদেশে গ্যাস সঞ্চালন নেটওয়ার্ক নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
১০টি গ্যাস সঞ্চালন লাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে জ্বালানি বিভাগ। এ জন্য প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার ৮৬২ কোটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুধু বছিলাই নয় শীত বাড়ার সাথে সাথে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় গ্যাসের চাপে তৈরি হয়েছে সংকট। তবে সবচেয়ে বেশি সংকট পোহাতে হচ্ছে রাজধানীর মহাখালী,রায়েরবাগ মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, কাজীপাড়া, ইন্দিরা রোড, গ্রিন রোড, কলাবাগান, শুক্রাবাদ, কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, রাজাবাজার, মগবাজার, মালিবাগ, তেজকুনিপাড়া, পশ্চিম রামপুরা, বাসাবো, আরামবাগ, আর কে মিশন রোড, টিকাটুলী, মিরহাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, জাফরাবাদ, লালবাগ, কেরানীগঞ্জ ও উত্তরার বাসিন্দাদের।
মগবাজার মধুবাগ এলাকার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী শ্যামা বলেন, গ্যাসের শিডিউল মেইনটেইন করতে গিয়ে অফিসের শিডিউল ফেইল করতে হচ্ছে আজকাল। সকাল ৯ টার পর থেকে চুলায় একটু গ্যাসের চাপ আসার জন্য তীর্থের কাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
তিতাসে অভিযোগ জানানোর সাথে সাথে তারা কিভাবে যেনো চাপ বাড়ায় কিন্তু পরের দিন আবার যেই সেই। এই অবস্থায় ঘরের খাবার খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।
তবে এতে করে পোয়াবারো হয়েছে হোটেল-রেস্তোরা মালিকদের। গ্যাস সংকটে বাসা-বাড়িতে রান্নার সুযোগ না থাকায় নগরবাসীদের বাধ্য হয়ে দুপুর এবং রাতের খাবার খেতে হচ্ছে এসব হোটেল-রেস্তোরাগুলোতে। পান্থপথের কাঁশবন রেস্তোরার ম্যানেজার রহমত মিয়া বলেন, রাস্তার এইপাড়ের বাড়িগুলোতে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক থাকলেও কলাবাগানের দিকে তীব্র গ্যাস সংকট। এইসব এলাকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগই আশেপাশের রেস্তোরাগুলো থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। ফলে আমাদেরও একটু ভালো ব্যবসা হচ্ছে।
হঠাৎ করে প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে তাপমাত্রা কমে গিয়ে গ্যাসের এই সাময়িক সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশনের কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, শীতের কারণে গ্যাসের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আবার অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে পাইপলাইনে প্রেসারও কম থাকে। তবে আমাদের কোনো সংকট নেই। কেউ গ্যাস সংকটের অভিযোগ করলে আমরা সাথে সাথে ওইসব এলাকায় কেনো সংকট হচ্ছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তবে আশা করছি শীত কমার সাথে সাথে ছোট খাটো সংকটও থাকবে না।
তিনি বলেন, আমাদের পাইপলাইনে এলএনজি চলে আসছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি নতুন করে আরও যোগ হবে। তাই বড় ধরণের গ্যাস সংকটের কোনো কারণই নেই। আগে পাইপলাইনের সমস্যার কারণে যেসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতো এখন আর তা হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, শীতের আগেই এইসব পাইপলাইন পরিস্কার করা হয়েছে। তবুও অভিযোগ পেলেই লোক পাঠানো হচ্ছে। পাইপলাইনে সমস্যা পেলে সমাধান করা হচ্ছে সাথে সাথে।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ আবাসিক গ্যাস সংযোগ রয়েছে। তবে শুধু আবাসিকে নয়, শিল্পাঞ্চলেও গ্যাস সংকট চলছে। বিশেষ করে রাজধানীর আশপাশে গাজীপুর, আশুলিয়া, টঙ্গী ও সাভারের শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ থাকছে না। সিএনজি পাম্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রেও একই অবস্থা। এখন গড়ে গ্যাস পাওয়া যায় এক হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে গ্যাসের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তিতাস গ্যাস বিতরণ কাম্পানির অধীনে যে গ্রাহক আছে তাদের পূর্ণ মাত্রায় গ্যাস সরবরাহ করা হলে দুই হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার।
তবে গ্যাসের কোনো ধরণের সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে দাবি করেছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, এলএনজি সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। এই সময়ে গ্যাসের সংকট থাকার কথা না। যদি কোথাও হয় তাহলে কেনো হচ্ছে তার কারণ বের করে সমাধান করতে তিতাসকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এবার পুরানো পাইপলাইন সরিয়ে নতুন করে পাইপ স্থাপনে বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ১২শ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিত হবে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ। আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এরপরই নতুন সংযোগের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা শহরে গ্যাস সরবরাহের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। চাপ প্রশমন করে ২ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে নব্বই দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে ৫০ পিএসআই (প্রতি বর্গফুটে গ্যাসের চাপ) চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর এলাকা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কও সম্প্রসারণ করা হয়। ৫০ পিএসআই চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। এই পাইপলাইনগুলোর মেয়াদকাল ছিল ত্রিশ বছর। কিন্তু এখনও সেই পাইপলাইন ব্যবহার করছে ঢাকাবাসী।