দেশকে উজাড় করে বিভিন্ন ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাচার হচ্ছে নগদ টাকা। এইসব আত্মসাতের টাকায় কানাডাসহ কয়েকটি দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাড়ি-গাড়ি কিনে বিলাস-বহুল জীবন-যাপন করছে অভিযুক্তরা।
তালিকায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার, সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হান্নান রতন, ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেন, আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামসহ রয়েছে আরও প্রায় ১শ’র জন অর্থ পাচারকারী।
তবে অবৈধভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা কিংবা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে-যেসব ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করে-সেসব দেশে অবস্থান করছেন এবং এসব অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মানিলন্ডারিং আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করেছে। তাদেরকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
দুদক সূত্রে জানা যায়, নিজ নামে ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ঋণ হিসাব ছাড়া অন্যান্য ব্যাংক হিসাবে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের পাশাপাশি ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। শুধু তাই নয় তার এবং তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে যে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে এর মধ্যে তার নিজ নামে পরিচালিত হিসাবগুলোয় ২৪০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ছিলো। এছাড়া তার মা লীলাবতী হালদারের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবে ১৬০ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয়।
দুদক বলছে, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যাপবার, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পত্তির মালিক এই প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে কানাডায় নিজ নামে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে নাম এসেছে সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহারও। সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ভূয়া তথ্য দিয়ে অন্যের নামে ৪ কোটি টাকার ঋণ সৃস্টি করে তা নিজের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং রুপান্তরের মাধ্যমে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত। তাকে গ্রেপ্তারে কানাডা সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন বলে দাবি করছে দুদক।
একই ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হান্নান রতনের বিরুদ্ধেও। ব্যবসার কথা বলে তিনি সোনালী ব্যাংক থেকে ৪ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ নেন ১৯৯৯ সালে। পরে চলতি মূলধন ঋণ নেন আরও তিন কোটি টাকা। এর খুব সামান্য অংশ দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসিকে কারখানা নির্মাণ করলেও বাকি টাকায় জমি কেনেন। বছর কয়েক পর সেই জমির দাম কয়েকগুণ হলে তা বিক্রি করে অবৈধভাবে অর্থ নিয়ে যান কানাডায়। পাচারের টাকায় বাড়ি কেনেন সেখানে। শুধু তাই নয় ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোতে তিনটি বাড়ি ও একটি রেস্তোরার মালিক হন তিনি। অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানায় দুদক।
এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকাধীন বেসিক ব্যাংকের ৩শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় আত্মগোপন করে আছেন স্ক্র্যাপ (জাহাজ ভাঙ্গা) ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেন। ব্যংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সহযোগীতায় এই তিনি ব্যবসার নামে অবৈধ অর্থ নিয়ে কানাডায় বিলাস-বহুল জীবন যাপন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে বলেছেন, জি বি হোসেন আদালতের আদেশ নিয়ে বিদেশ যান। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি তিনি কানাডায় আছে। তার বাড়ি ও কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা আমরা পেয়েছি। মিচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্টের (এমএলএআর) এর মাধ্যমে আমরা তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।
জানা যায়, বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন মেসার্স বেলায়েত নেভিগেশনসহ বেশ কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে। তার মূল ব্যবসা পুরনো জাহাজ এনে ভাঙা বা স্ক্র্যাপের। এসব ঋণ নেওয়ার জন্য বেলায়েত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তৎকালীন গুলশান শাখার ম্যানেজার শিপার আহম্মেদসহ কয়েক কর্মকর্তাকে বিশাল অঙ্কের ঘুষ দেন। ঋণ জালিয়াতির এসব নথিপত্র তৈরি করে দিয়েছেন শিপার আহম্মেদ। দুদকের মামলা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে শিপার।
এদিকে প্রায় ১১ হাজার গ্রাহকের জমা করা ৩শ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং শত কোটি টাকা কানাডা পাচারের অভিযোগ রয়েছে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। বিদেশে পাচার হওয়া তার অবৈধ অর্থও দেশে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে অবৈধভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা কিংবা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে-যেসব ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করে-সেসব দেশে অবস্থান করছেন এবং এসব অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মানিলন্ডারিং আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করেছে। তাদেরকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, যে বা যারা অবৈধভাবে ব্যাংকের বা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে, তা পাচার করে বিদেশে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন, তাদের প্রত্যেককেই অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক সকল আইনি টুলস-টেকনিক প্রয়োগ করে অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে এবং দেশের সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে।