মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সদ্য পদত্যাগ করা মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে এবার দেশ-বিদেশে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকেই ফের ক্ষমতায় দেখতে চান সেখানকার অধিকাংশ মানুষ।
সাউথ চীনা মর্নিং পোস্ট ও দ্য স্টার অনলাইনের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়, আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই মাহাথিরকে ফের ক্ষমতায় ফেরানোর প্রচেষ্টা চলছে। কেননা মালয়েশিয়ার জনগণ একচেটিয়াভাবে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের পক্ষে রয়েছে।
এদিকে আনোয়ার ইব্রাহীম দাবি করছেন জোট পাকাতান হারাপান তাকে দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে। বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দেশটির জাতীয় দৈনিক মালয় মেইল ও কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা বলছে, আনোয়ার ইব্রাহীমের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে টালমাটাল মালয়েশিয়ার রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিল। এর আগে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ কোনো কারণ না জানিয়ে পদত্যাগ করেন। এরপর দেশটির রাজা তাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। আনোয়ার ইব্রাহীমের পিপলস জাস্টিস পার্টি (পিকেআর) সদস্যরাও ঘোষণা দিয়েছেন যে, তারা দেশনেতা হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহীমকেই মনোনীত করেছেন।
মাহাথিরের কার্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) স্থানিয় সময় বেলা ১১টায় বৈঠকের জন্য তাকে ডেকেছেন রাজা। কিন্তু কেন ডাকা হয়েছে, তা বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করলেও তুন মাহাথির মোহামাদ বার্সাটু চেয়ারম্যান পদে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন বলে, বেরাসাতুর মহাসচিব দাতুক মারজুকি ইয়াহিয়ার উদ্বৃতি দিয়ে বার্নামার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও বেরসাতু চেয়ারম্যান উভয়ই পদত্যাগ করার ঠিক কয়েকদিন পরে তুন মাহাথির স্বপদে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অন্তর্র্বতী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ড. মাহাথির মোহাম্মদ (৯৪) কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিশ্চিত নয়। কবে নাগাদ একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে তাও স্পষ্ট নয়। পরবর্তী সরকার কবে গঠন হবে তা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। সব মিলে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে মালয়েশিয়ার রাজনীতি।
বিশ্লেষকদের মতে, মাহাথিরের আগের আমলে সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে থাকা আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রতিশ্রুত দিয়ে মূলত ক্ষমতায় ফিরেন দেশটির কিংবদন্তি নেতা। যদিও এতদিন পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো নাম নেননি তিনি। যার প্রেক্ষিতে আনোয়ার গত কয়েক মাসে মাহাথিরের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন।
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মাহাথিরের সমর্থকরা আনোয়ারকে বাদ দিয়েই দেশে নতুন জোট গড়ার পায়তারা শুরু করেন। এরই মধ্যে গত সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে আচমকা পদত্যাগ করে বসেন মাহাথির। পরে সন্ধ্যা নাগাদ সরকারের মুখ্য সচিব দাতুক সেরি মোহাম্মদ জুকি আলী বিবৃতি দিয়ে জানান, মাহাথিরকেই দেশের অন্তর্র্বতীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম মালয়েশিয়া’স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ব্রিজেট ওয়েলশ মনে করেন, জনগণের সমর্থন বেশি থাকায় মালয়েশিয়ার রাজা মাহাথিরকেই ক্ষমতায় রেখে দিতে চাইছেন। মূলত আনোয়ারকে ক্ষমতাহীন করার প্রধান কৌশল এটি।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মাহাথির মূলত ‘ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন’ দলের একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ নেতা। দীর্ঘ ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৩ সালে তিনি সরে দাঁড়ান।
লম্বা সময় বিরতি নেওয়ার পর বছর দুই আগে আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসেন তিনি। তখন যোগ দেন কারাবন্দি আনোয়ারের পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন দলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন,২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বড় ধরণের বিজয়ের মাধ্যমে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। নির্বাচনে জয় লাভের পর পাকাতান হারাপান জোটের প্রধান হিসেবে সে বছরের ১০ মে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মাহাথির মোহাম্মদ। এর পরপরই আনোয়ার ইব্রাহিমের কারামুক্তির ঘটনাকে দেশটির নতুন সূচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কেননা এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে আনুগত্যের পরীক্ষার লড়াইটা ছিল স্পষ্ট। তখন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন রোমের জন ক্যাবট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ব্রিজেট ওয়েলশ।
২০১৮ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে এই সম্পর্কের গল্পটি এতোটাই নাটকীয় যে একে শেক্সপিয়ারের নাটকের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে কাহিনীর মধ্যে আনুগত্য, বেইমানি, ট্রাজেডি এবং বিদ্রূপ একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে।
ড. মাহাথিরের বয়স তখন ৯২। ১৯৯৯ সালে দেশটির অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দুর্নীতি এবং সমকামিতার অভিযোগে জেলে পাঠিয়েছিলেন। তখন জেলে বসে আনোয়ার শেক্সপিয়ারের প্রতিটি গ্রন্থ পড়ে শেষ করেন। কিন্তু তিনি ভাবতেও পারেননি এই নাটকের আবির্ভাব হবে তার রাজনৈতিক জীবনে।
ড. মাহাথির জয়লাভের পর তিনি আনোয়ারের মুক্তি ও ক্ষমা নিশ্চিত করলে দুইজনের সম্পর্ক একই বৃত্তে আসে। শত্রু হয়ে পড়েন বন্ধু, ঠিক শেক্সপিয়ারের নাটকের মতই যেখানে গল্পের এক পর্যায়ে খলনায়ক, নায়ক হয়ে ওঠেন।
এই দুইজনের সম্পর্ক উন্নয়নের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং একে অপরের ঢাল হওয়া। ড. মাহাথির ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আনোয়ারকে তার প্রশাসনে জায়গা দেন।
আনোয়ার একজন দৃঢ়চেতা, উদ্যমী ছাত্র নেতা ছিলেন। যিনি সত্তরের দশকে তৎকালীন প্রভাবশালী দল ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন-ইউএনএমও এর বিরুদ্ধে একটি দল গঠন করতে পেরেছিলেন।
হয়ে উঠেছিলেন দেশটির স্থানীয় প্রবক্তা, যিনি ওই শক্তিশালী দলটির বিরোধিতা করতে পেরেছেন। তার ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার কারণে তার সমর্থকরা এমনভাবে কাজ করেছে যেন বিরোধীরা একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে চলে আসে। আশির দশক এবং নব্বইয়ের শুরুটা ছিল মালয়েশিয়ার জন্য সুবর্ণ সময়, যখন দেশটিতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটে। বিশ্বে যখন এশিয়ার প্রভাব বাড়ছিলো ঠিক তখনই ড. মাহাথির তার নেতৃত্বে মালয়েশিয়াকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন।
২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজির রাজাকের বিরুদ্ধে গৃহায়ন খাতে দুর্নীতির ওয়ান এমডিবি কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে এবং তার এমন কিছু সম্পদের তথ্য পাওয়া যায় যেগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে বলে মনে করা হতো।
এ অবস্থায় খোলাখুলিভাবে নাজিব রাজাকের নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করেছেন ড. মাহাথির। পরে নাজিব রাজাক ড. মাহাথিরের সঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রমণে জড়িয়েযান। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি মামলা দায়েরের হুমকি দেন।
নাজিব রাজাক দুর্নীতির সঙ্গে তার কোনরকম সংশ্লিষ্টতা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন। আনোয়ারের মতো ড. মাহাথিরকেও একই ফাঁদে ফেলতে চাইছিলেন নাজিব রাজাক। এ অবস্থায় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ড. মাহাথির বিরোধী দলের সাথে কাজ করতে শুরু করেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই সম্পর্কের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ জুড়ে ছিল আনোয়ারকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরানো এবং তার মুক্তি এবং ক্ষমা সুরক্ষিত করা। নাজিবের পতন, আইনের শাসন পুনর্বহাল এবং রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেয়ার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৯ মে মাহাথির বিরোধীদের জয় ছিনিয়ে নেন।
উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন যাবত ক্ষমতাসীন পাকাতান হারাপান জোটের নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করায় জোট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বিরোধী দল ‘উমনো অ্যান্ড পার্টি ইসলাম সে-মালয়েশিয়া’-এর (পিএএস) নেতৃত্বে শিগগিরই দেশটিতে নতুন সরকার আসতে পারে বলেও ধারণা করছেন অনেকে।
মূলত এসব কারণেই মাহাথির মোহাম্মদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দাবি দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।