বিশেষ প্রতিনিধি: অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচ খেললেন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। বিজয়ের মালা গলায় নিয়ে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে রাজকীয় বিদায় নিলেন ভক্তদের ভালোবাসার “ক্যাপ্টেন”।
জিম্বাবুয়ের সাথে শেষ ওয়ানডে ম্যাচের খেলায় জয় নিশ্চিত হতেই মাশরাফিকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন তামিম ইকবাল। পিছু নিল পুরো দলও। ভিআইপি গ্যালারির সামনে গিয়ে থামল সেই মিছিল। মিছিলের স্লোগানও তুমুল স্বরে উঠতে থাকল গ্যালারি থেকে, ‘মাশরাফি, মাশরাফি’। পুরো গ্যালারী তখন উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা আর স্যালুট জানায় প্রিয় অধিনায়ককে।
এ রকমই হওয়ার কথা ছিল। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডের আবেদন যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, সেটিও তো আগের দিন মাশরাফির অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর নিজের কাছে এই ম্যাচের আবেদন কমেনি এতটুকু। কারণ এ রকম ম্যাচ যে অনেক ভুলের দুয়ারও খুলে দাঁড়ায়। অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচে এ রকম কিছু হোক, তা চাননি কোনোভাবেই, ‘মনে হচ্ছিল ভুল যেন না করি। শেষ বলে দিলে ভুলের সুযোগ বেড়ে যায়। কারণ এরপর আর জবাবদিহি নেই।’
কিন্তু সতীর্থরা যে ঠিক করে রেখেছিলেন তাঁকে কোনোভাবেই এ রকম কিছু হতে দেবেন না। বরং ম্যাচটি এমন জায়গায় নিয়ে যাবেন, যাতে জয় নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তাই না থাকে। নেতৃত্বের শেষ ম্যাচে মাশরাফি টস হারলেও আগের দুই ম্যাচের মতো বাংলাদেশ ব্যাটিংই পেল। এবং আগের দুই ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান লিটন কুমার দাস ও তামিম এবার একযোগে সেঞ্চুরি করলেন। বৃষ্টিতে ৪৩ ওভারে নির্ধারিত হওয়া ম্যাচে একের পর এক রেকর্ডও গড়ে গেলেন তাঁরা। তামিম-লিটন মিলেই যেন অধিনায়কের জন্য রেকর্ডখচিত এক বিদায়মাল্যের আগাম বন্দোবস্ত করে রাখলেন।
তামিমকে টপকে লিটন নিজে খেললেন দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৭৬ রানের ইনিংস। ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো টানা দুই সেঞ্চুরি করা তামিম ইকবাল অপরাজিত থাকলেন ১২৮ রানে। দুই ওপেনারের সেঞ্চুরির ‘যুগলবন্দি’ও বাংলাদেশের জন্য এই প্রথম। সেই সঙ্গে তাঁরা দুজন মিলে এমন এক রেকর্ডও গড়ে রাখলেন, যেটি খুব সহজেই ভাঙবে বলে মনে হয় না। যেকোনো উইকেটে দেশের সর্বোচ্চ ২৯২ রানের সূচনায় দলও এমন জায়গায় (৩২২/৩) চলে গেল যে বৃষ্টি আইনে জিম্বাবুয়ের জন্য তা বেড়ে হয়ে গেল ৩৪২। ম্যাচ সেখানেই শেষ।
বাকি ছিল আনুষ্ঠানিকতা। ১২৩ রানের জয়ে সেই পর্ব শেষ হতে না হতেই দলের কেউই আর আলাদা থাকলেন না। সতীর্থরা মিলে অন্যরকম এক আয়োজনে অধিনায়ককে চমকে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল সবাই এক। সবার জার্সি নম্বর এক, জার্সির পেছনে নামও তাই। সবাই যে তখন দুই নম্বর জার্সি পরা মাশরাফি বনে গিয়েছেন। সবার জার্সির বুকে লেখা ‘ধন্যবাদ’। বোর্ড সভাপতি তাঁকে ক্রেস্ট দিলেন। থাকল আরো ছোটখাটো কিছু আনুষ্ঠানিকতাও।
মাঠের বাইরে অন্যরকম কিছু করে চমকে দেওয়ার চিন্তাই শুধু ছিল না মাশরাফির সতীর্থদের। মাঠেও ছিল ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা। ম্যাচসেরা এবং তামিমের সঙ্গে যৌথভাবে সিরিজসেরা লিটন রাতের সংবাদ সম্মেলনে এসে বলে গেলেন, ‘আমরা সবাই চাচ্ছিলাম উনাকে একটি উইনিং নোট দিয়ে বিদায় দিতে। তাই ভালো একটা কিছু করার চেষ্টা ছিল।’ সেই চেষ্টায় ব্যাটিংয়ে তামিম-লিটন জুটি এমন বিশেষ কিছু করে ফেলল যে অন্যদের আর করতে হলো না তেমন কিছুই। বোলিংয়ে ৪ উইকেট নিয়ে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও আলো ছড়ালেন। আর জিম্বাবুয়ের রান তাড়ায় প্রথম আঘাত হানা মাশরাফিও নেতৃত্বের শেষ ম্যাচে জয়ে নিজের ছোঁয়া রাখলেন।
লিটনকে নিয়েই রাতের সংবাদ সম্মেলনে বসা মাশরাফিকে তাই ভীষণ নির্ভারও মনে হচ্ছিল, ‘অসম্ভব ভালো লাগছে। অনেক কাজ ছিল। এর মধ্যে বড় একটি কমে গেল। ভালো লাগছে, অধিনায়ক হিসেবে ভালো একটি জায়গায় থেকে শেষ করলাম।’ সতীর্থরা তাঁকে এদিন অধিনায়ক হিসেবে তাঁর ৫০তম জয়ও তো উপহার দিয়েছেন। সংখ্যাই নেতা মাশরাফির সাফল্যকে তুলে ধরছে। এমন একজনের নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় পদক্ষেপ ফেলেছে, মাঠ ও মাঠের বাইরে সতীর্থদের আগলে রেখেছে, তাঁকে একটু কষ্ট হলেও কাঁধে তো তামিম তুলে নেবেনই!