বিশেষ প্রতিনিধি:
জীবন আর মৃত্যু দুটোকেই একসাথে খুব কাছ থেকে দেখেছি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকে। একটু পানির জন্য আমি যেমন চিৎকার করেছি তেমনি পাশের বেডের মানুষটাকে পানির জন্য আর রোগ যন্ত্রণায় চিৎকার করতে দেখেছি। আবার সেই মানুষটার নিথর দেহ লাশের ব্যাগে ভরতে দেখেছি। সেসময় প্রতি মুহুর্তে মনে হতো আমিও তাদের মতো মরে যাবো। যে কোনো সময় আমার দেহটিও হয়তো এভাবে লাশের ব্যাগে ঢোকানো হবে। স্বামী সন্তানকে খুব দেখতে ইচ্ছে হতো। এভাবেই হাসপাতালের দিনগুলির বর্ণনা দিচ্ছিলেন বৃদ্ধা পারুল গোমেজ। বয়স ৬৫ পার হয়েছে তার। কিন্তু বার্ধক্য তাকে কাবু করতে পারেনি।
বাংলাদেশের নবাবগঞ্জের পারুল স্বামী সন্তান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন নিউ ইয়র্কে। এ্যাস্টিারিয়ার একটি বাঙালী পরিবারের একটি “স্পেশাল চাইল্ড” এর হোম এটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি। গতমাসে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১০দিন হাসপাতালে ছিলেন তিনি। মরণব্যাধীর সাথে লড়াই করে সুস্থ্য হয়ে ফিরেছেন স্বামী-সন্তানদের কাছে। আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠছেন। কিন্তু হাসপাতালের সেই বিভিষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা ভুলতে পারছে না। সেসব কথা মনে উঠলে এখনও গা শিউরে উঠে তার।
বৃদ্ধা পারুল গোমেজ জানান, তার ছেলে কাজের জায়গা থেকে জ্বর অবস্থায় বাসায় ফিরেছিলেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। তারপর ছেলে বউ এবং ছোট্ট নাতিরাও অসুস্থ হয়। ছেলে কিছুই খেতে পারে না। একদিন সকালে তার জন্য নাস্তা তৈরি করার সময় হঠাৎ করে আমার বমি শুরু হল। বমি করে খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ি। ছেলে এসে আমাকে নাস্তা করালো, চা ও পানি খাওয়ালো। তারপর কিছুটা সুস্থ বোধ করলাম। কিন্তু রাত থেকে ডায়রিয়া এবং আবারো বমি শুরু হলো। এম্বুলেন্স কল করা হল। ডাক্তাররা এসে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলল, তেমন কিছুই হয়নি। বাসায় থাকার জন্য বললো। প্রাইমারি ডাক্তারকে কল করতে বলল। ডাক্তার ওষুধ দিলেন কিন্তু বমি ও ডায়রিয়া কমছিল না।
পরদিন আবারো এ্যাম্বুলেন্স কল হল। ডাক্তাররা এবার টেস্ট করে বললেন-করোনা ভাইরাস পজিটিভ এসেছে। তারা অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেল আমাকে। একটা স্কার্ট আর গেঞ্জি পরে গেলাম। সঙ্গে কাউকে যেতে দেয়নি। জ্যামাইকার কুইন্স হাসপাতালের সামনে যাওয়ার পর দেখি এম্বুলেন্সের লম্বা লাইন। ভিতরে ঢুকতেও দীর্ঘ সময় লাগল।
পারুল গোমেজ জানান, ইমার্জেন্সিতে যেখানে একশ’ মানুষের জায়গা হবার কথা, সেখানে সহস্রাধিক মানুষের ভিড়। রোগি দেখার মতো চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। কাকে রেখে কাকে দেখবে তা কেউ জানে না। চারিদিকে করোনা আক্রান্ত অসুস্থ্য মানুষের চিৎকার। ডাক্তার-নার্সরা চারিদিকে ছোটাছুটি করছে। তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা।
সেই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে ৬৫বছরের এই বৃদ্ধা জানান, এ অবস্থা থেকে বেঁচে পরিবারের কাছে ফিরতে পারবো সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কাছে ফোন না থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। হাসপাতালের বেডে তিন দিন শুয়ে ছিলাম। বেশিরভাগ সময় জ্ঞান থাকতো না। যখন জ্ঞান ফিরে আসতো তখন একটু পানির জন্য চিৎকার করতাম। গলা শুকিয়ে যেত। কথা বলতে পারতাম না। দম বন্ধ হয়ে আসতো। পানির পিপাসায় মনে হতো বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে কিন্তু পানি দেবার মতো কেউ ছিল না। কয়েক ঘন্টা ধরে চিৎকার করতে করতে তারপর হয়তো একটু পানি পেতাম। পায়খানা করে পরনের কাপড় এবং বিছানা নষ্ট করে সেই অবস্থায় পড়ে থাকতাম। কিন্তু দেখার কেউ ছিল না। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট থাকা স্বত্তেও তিন দিন অক্সিজেন পাইনি।
আইসিইউ এবং হাসপাতালের ভিতরের অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা পারুল গোমেজ জানান, আমার আশেপাশের রোগিদের অবস্থা ছিল আমার মতো একই রকম। চিৎকার করতে করতে একসময় তারাও ঘুমিয়ে পড়তো। কেউ কেউ জেগে উঠে আবারো পানির জন্য চিৎকার করতো। কখনও দেখতাম আমার পাশের রোগি অনেক্ষন ধরে ঘুমিয়ে আছে। একসময় যখন দেখতাম তাকে ব্যাগের মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে। তখন বুঝতে পারতাম সে মারা গেছে অনেক আগেই। পাশে থাকা মানুষটিকে লাশের ব্যাগে ঢোকানোর দৃশ্য দেখে ভয়ে গা শিউরে উঠতো। নিজের শরীরে চিমটি দিয়ে দেখতাম যে আমি বেঁচে আছি কি না। খালী হয়ে যাওয়া সেই বেডে নতুন রোগি আসতো। কয়েকদিন পর তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে আবার একদিন লাশের ব্যাগে ঢোকানো হতো। জীবিত মানুষের কষ্ট, চিৎকার আর সেই একই মানুষের মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখন মনে হতো আমিও হয়তো তাদের মতো মারা যাবো। আমার নিথর দেহটিও একদিন এভাবে বিশেষ ব্যাগের মধ্যে ঢোকানো হবে। পরিবারের কাউকে আর হয়তো দেখতে পাবো না। শেষ বারের মতো স্বামী সন্তানের মুখটাও দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমি আস্তে আস্তে সুস্থ্য হতে শুরু করি। ডাক্তাররা আশ্বস্ত করেন যে আমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে উঠবো। কিন্তু আমার মনের মধ্যে আতংক কাটে না। সবসময় ভয় করে। জীবিত আর মৃত সেই মুখগুলি সবসময় চোখের সময় ভাসে।
পারুল গোমেজ বলেন, তার পাশের বেডের এক মহিলা রোগির খুব বেশি শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে ভেন্টিলেটরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চিকিৎসকরা তাকে বললো- ‘ একটু পরে তোমাকে ভেন্ডিলেটরে নেয়া হবে। কিন্তু তোমার শরীরের অবস্থা ভালো না। তুমি সেখান থেকে ফিরে আসতো পারো, আবার নাও ফিরতে পারো। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তবুও তুমি শেষ কথা কিছু বলতে চাও? মহিলার দু’চোখ দিয়ে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে। সে ডাক্তারদের বললো- ‘আমার স্বামীকে জানিয়ে দিও যে- ”আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। আমাকে যেন সে ক্ষমা করে দেয়।” এরপর তাকে ভেন্ডিলেটরে নিয়ে যাওয়া হলো। হাসপাতাল থেকে আসার আগে জানতে পারিনি যে সেই মহিলা বেঁচে আছে কি না।
১০দিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। তার আগে পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি এবং আমার পরিবারের কেউই আমার সুস্থ্য বা অসুস্থ্যতার ব্যাপারে কোনো খবর নিতে পারেনি। হাসপাতালে থেকে আমি আর বাড়িথে থেকে আমার পরিবার এক ভয়ংকর দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটিয়েছি প্রতিটা মুহুর্ত। বাসার ফেরার পর এখন আস্তে আস্তে দুর্বলতা কাটিয়ে সুস্থ্য হয়ে উঠছি। পয়ষট্টি বছর বয়সে করোনা যুদ্ধে জয়ি হয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকে আমাকে দেখে এখন অনেকেই সাহস পাচ্ছে।