যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে পুষ্ট রেমিট্যান্সে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, সেই প্রবাসী কর্মীদের খোজঁ রাখেনা কেউ। একটু সুখের আশায় পরিবার-পরিজন ফেলে সর্বস্ব ব্যয় করে তারা খেটে মরছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। সুখের দেখা অনেকের মিলেছে, অনেকের মেলেনি। তারা পড়েছে দালালদের পাল্লায়। কর্মহীন হয়ে বেচেঁ থাকার আকুতি নিয়ে কাটছে তাদের দাসত্বের জীবন।
বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয় দালালদের শ্রমিক শোষণ। বিগত জিটুজি প্লাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে দেশী রিক্রুটিং এজেন্সি সরকারের বেঁধে দেওয়া ব্যয়ের চেয়ে শ্রমিকপ্রতি আদায় করেছে ৩ থেকে শুরু করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। শুরুতেই একজন শ্রমিকের গচ্চা যায় তিন থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। এরপর মালয়েশিয়ায় নির্দিষ্ট কোম্পানিতে পৌঁছেই পড়েন জিম্মি বাণিজ্যের কবলে। পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রেখে দাবি করা হয় বাড়তি টাকা বা বেতনের অংশ। সেটা দিলেই কাজ মেলে।
এখানেও আরেক কারসাজি। শ্রমিকটি যে কোম্পানিতে এসেছেন, হয়তো তাদের কোনো কর্মক্ষেত্রই নেই; নামমাত্র দালালির কোম্পানি। তারা তখন শ্রমিকটিকে অন্যত্র চাকরিতে দেয় চুক্তির চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি বেতনে এবং মাসশেষে বাড়তি টাকাটা নিজেরা পকেটস্থ করে। দুই-চার মাস পর সেই ভাড়া দেওয়া শ্রমিকটিকে চুক্তির প্রাপ্য টাকাকাও দেওয়া হয় না; কেটে রাখা হয় লেভি, ঋণ, থাকাসহ নানা অজুহাতে যা চুক্তি অনুয়ায়ী করার কথা না থাকলেও চলছে শোষন।
সরেজমিনে দেখা যায়, এমসিসি ইষ্ট মালয়েশিয়া এসডি এন বিএইচডির সাপ্লাইয়ার কোম্পানীর সেরি সারডাং গোডাউনে পড়ে রয়েছেন প্রায় ৭০ জন বাংলাদেশি কর্মী।
বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ইউনিক ইষ্টার্ণ, রাব্বি ইন্টা:, কাতারসিস, সানজারিনের মাধমে মালয়েশিয়ায় যান। মানুষ বসবাস করার মত গোডাউনে নেই কোনো ব্যবস্থা। এত অপরিস্কার, নোংরা পরিবেশ দেখলেই গাঁ-শিউরে উঠার মত। গাদাগাদি করে ৭০ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। সবার মূখে বিষন্নতার ছাপ। কেউ ভয়ে কথা বলতে রাজি নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, কি আর বলব। আপনি এসেছেন কুশল বিনিময় করে চলেযান। সাপ্লাইয়ার কোম্পানির লোকজন রয়েছে। কিছু বললে আপনি যাওয়ার পরেই আমাদের উপর শারিরীক নির্যাতন চলবে। এ পর্যন্ত যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের উপর শারিরিক, মানষিক নির্যাতন চলে। প্রতিবাদ করায় কয়েকজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কোথায় আছে কেউ জানেনা। এমনকি কোম্পানিও এদের খোজঁ নেয়না। আমরা গোডাউনে পড়ে রয়েছি বেচেঁ থাকার তাগিদে।
তিনি আরো বলেন, টানা লকডাউনে সাপ্লাইয়ার কোম্পানির লোক এসে ১০০ রিঙ্গিত করে দিয়েছিল, পরে আর দেয়নি। যোগযোগ করলে গালিগালাজ করে। বাড়ি থেকে টাকা আনার কথা বলে। টানা ২ মাস ধরে আমরা কষ্টে রয়েছি। এমন পরিস্থিতির কথা জানাতে কয়েকদিন হাইকমিশনের টেলিফোন নাম্বারে ফোন করেছি। কেউ রিসিভ করেনি।
দালালের প্রলোভনে পড়ে স্থানীয় এজেন্সির মাধ্যমে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার তারা। দালালের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে তামিল গ্যাং দিয়ে চলে শারিরিক নির্যাতন। কখনও কখনও এক-দুই মাস কাজ করিয়ে নিয়ে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিচ্ছে একশ্রেণির বাংলাদেশি দালাল।
পটুয়াখালির মরিচ বুনিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল ওয়াহাব ফকিরের ছেলে রাসেল মাহমুদ (২৮) অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেতে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে একই গ্রামের দালাল মজিবুরের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। ২০১৭ সালের ১১ জুন ঢাকার ইউনিক ইষ্টার্ণ ওভার্সিজের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ায় যান রাসেল।
রংপুর জেলার পীরগাছা থানার গগুয়া গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেলে ইসলাম মো. সাইদুল ২০১৮ সালের নভেম্বরে একই কোম্পানীতে দালাল মজিবুরের হাত ধরে ইউনিক ইষ্ঠার্ণ এজেন্সির মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ায় যান। যাওয়ারপর ১৭ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত মাত্র ৭ মাস কাজ করেছেন। বাকি দিন গুলো বিভিন্ন গোডাউনে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে রাসেল মাহমুদের। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়ে একই অবস্থায় পড়েছেন সাইদুলও। শুধু সাইদুল আর রাসেল মাকমুদই নয় তাদের মত আরোও ৭০ জন স্বপ্নবাজ তরুনও নির্যাতনের শিকার। কিন্তু কথায় আছে, ‘অভাগারা যেদিকে যায় নদী শুকিয়ে যায়।’ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর ভাল কাজ পাওয়া তো দুরের কথা, বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন স্বপ্নবাজ এই তরুণরা।
এভাবে পদে পদে শোষিত হয়ে দিশেহারা অনেকে রাস্তা খোঁজেন পালানোর। মূল কোম্পানি এ অবস্থা টের পেয়ে তাঁকে নিয়ে শুরু করে বেচাকেনার খেলা। হাত বদল হতে হতে নিঃশেষ হয়ে একসময় পালিয়ে যান, কিন্তু গিয়ে পড়েন আরেক ফাঁদে। এখন তিনি অবৈধ শ্রমিক। স্বাধীনভাবে চাকরি খুঁজে নিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকতে হয় তাদের। এমন সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মালিক ভালো হলে বেতন থেকে কোনো কাটাকাটি নেই। ধারদেনা কিছু শোধ করতে পারেন, দেশের বাড়িতেও কিছু পাঠাতে পারেন। কিন্তু চোরের মতো আর কত? ধরপাকড়, পুলিশের তাড়া লেগেই থাকে।
এভাবে একসময় এসে পড়ে বৈধ হওয়ার সুযোগ। এখানে ফাঁদ পেতে বসে থাকে নামসর্বস্ব কিছু কোম্পানির বৈধকরণ-নবায়নের ফাঁদ। এখানে গুনতে হয় সরকার নির্ধারিত বৈধকরণ ফির চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ-চারগুণ টাকা। বছর শেষে আবার আসে ভিসা নবায়নের পালা। সেখানেও একই অবস্থায় দিতে হয় কয়েকগুণ বেশি টাকা। এতেও শেষ নয়। ওই কাগুজে কম্পানিগুলোও শ্রমিকদের নিয়ে শুরু করে বেচাকেনা ও ভাড়া খাটানোর খেলা। এবারও শ্রমিকদের প্রকৃত পাওনা থেকে কমিশনের নামে টাকা চলে যায় কম্পানিরূপী দালালদের পকেটে। এভাবে চলে বছরের পর বছর।
এসব মজুরি-খোয়ানো অসহায় মানুষগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো অভিযোগ করেন না। যেহেতু তাদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না। আর সমাজের মুখোশধারী এই ছদ্মবেশীদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না- এ ভয়ও সর্বক্ষণ তাদের তাড়া করে ফেরে।
কিন্তু সমাজের অতি সাধারণ আর অবস্থার ফেরে সবচেয়ে অসহায় আর বিপন্ন এই মানুষগুলো বিচার দিয়ে রেখেছেন উপরওয়ালার কাছে। তিনি ছাড়া বিদেশ বিভূঁইয়ে তাদের আর কেইবা আছে!
মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন ক্যারাম এশিয়ার সাবেক সমন্বয়কারী হারুন-উর রশিদ। তাঁরও ভাষ্য, কোম্পানিরূপী দালালদের প্রতারণার কারণে অনেক কারখানায়ই বাংলাদেশি শ্রমিকরা ক্রীতদাসের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। দালাল কম্পানিগুলো অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশি বেতনে চুক্তি করে শ্রমিকদের কম বেতন ধরিয়ে দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করে; আবার সেই কম বেতন থেকেও নানা ছুতায় টাকা কেটে নেয়। অনেক যুবক বিদেশ গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সরকারের উচিত এসব দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।’