তুহিন সানজিদ, নিউ ইয়র্ক:
সারাফ মির্জার বয়স চার পেরিয়েছে সবেমাত্র। জীবন-মৃত্যু কি সেটা বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। এ বয়সেই সে হারিয়েছে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে। দু’মাস পেরিয়ে গেলেও নিষ্পাপ শিশুটি এখনও জানে না অভিশপ্ত করোনা চিরদিনের মতো কেড়ে নিয়েছে তার বাবাকে। সব আবদার, দুষ্টামি নি:শর্তে মেনে নেবার সেই মানুষটাকে আর কাছে পাচ্ছে না শিশু সারাফ।
অফিস শেষে সন্ধ্যার পরে বাসায় আসতো তার বাবা। সেই সময়টা তার অতি চেনা। তাইতো এখন প্রতিদিনই সেই সময়ে বাবার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে সে। সময়টা পেরিয়ে গেলে ময়ের কাছে জানতে চায় “কখন ফিরবে বাবা। আজ এত দেরি হচ্ছে কেন?” তারপর বারান্দায় গিয়ে বাবার আসার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাসায় ফিরলে বাবার সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠা, খেলা আর গাড়িতে করে ঘুরতে যাওয়াটা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। কিন্তু সেই রুটিনে ছন্দপতন ঘটেছে। তাই কিছুই ভালো লাগে না সারাফের। মুখ ভার করে অপলক চেয়ে থাকে আকাশের দিকে।
ঘুমোতে যাবার সময় বাবাকে সবচেয়ে বেশি খোঁজে ছোট্ট সারাফ। কেননা বাবার গলা জড়িয়ে না ধরলে যে ঘুম আসে না তার। এঘর ওঘর খুঁজে বেড়ায়। না পেয়ে আবারো অনেক প্রশ্ন। মায়ের কাছে সেসব প্রশ্নের কি কোনো জবাব আছে? অভিশপ্ত করোনা ভাইরাস চিরদিনে মতো কেড়ে নিয়েছে তাদের বাবাকে-একথা কিভাবে বলবে বা বোঝাবে ছোট্ট এই শিশুটিকে। সে ক্ষমতা যে নেই তাদের মায়ের।
সারা মির্জার সময় কাটে আরো নিষ্ঠুর কষ্ট নিয়ে। নয় বছরের শিশুটি সারাক্ষন বাবার জন্য কাঁদে। বাবার ছবি একেঁ তার নিচে লেখে “লাভ ইউ বাবা”। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বোনের চোখের জল দেখে কেঁদে ফেলে চার বছরের সারাফও। পিতা হারা দুই সন্তানের এ দৃশ্য দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে তাদের মা।
নিউ ইয়র্কে করোনা পরিস্থিতির প্রথম দিকেই মৃত্যুবরণ করেন বাঙালি কমিউনিটির প্রিয়মুখ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মির্জা হুদা। জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিলে তাকে ১৮ মার্চ হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থার অবণতি হলে চিকিৎসকরা তাকে প্রথমে আইসিইউ এবং পরে ভেন্ডিলেশনে নেয়। ২৭ মার্চ থেকে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২৯ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় না ফেরার দেশে চলে যান প্রবাসীদের এই প্রিয় মুখ। তাঁর মৃত্যু সংবাদে নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। ১ এপ্রিল লংআইল্যান্ড মেমোরিয়াল কবস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
মির্জা হুদা তার মা, স্ত্রী, মেয়ে সারা মির্জা (৮) এবং ছেলে সারাফ মির্জাকে (৪) নিয়ে নিউ ইয়র্কের লংআইল্যান্ডে বসবাস করতেন। তার মৃত্যুর পর স্ত্রীও অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় তাদের দুই শিশু সন্তানকে হুদার বড় বোনের বাসায় রাখা হয়। ১৪দিন কোয়ারেনটাইন শেষ হলে মায়ের কাছে ফিরে আসে বাবা হারা দুই শিশু।
বাংলাদেশে যশোরের শহরতলী পালবাড়ি এলাকার মুর্তির মোড়ে মির্জা হুদার বাড়ী। দুই বোন পাঁচ ভাই তারা। বড়বোন ফিওনা মির্জাও লংআইল্যান্ডে বসবাস করেন।
তিনি ১৯৯১ সালে যশোর নতুন খয়েরতলা মাধ্যমিক স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৩ সালে ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ১৯৯৬ সালে তিনি আমেরিকায় চলে আসেন। এরপর লংআইল্যান্ডের ওয়েস্টবারি কলেজ, কুইন্স কলেজ ও বিখ্যাত হান্টার কলেজ থেকে তথ্যপ্রযুক্তির উপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। নিজেকে আইটি সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমেরিকার বিভিন্ন বিখ্যাত কোম্পানীতে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন।
সর্বশেষ নিউ ইয়র্কের স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় ‘আ্যড এন্ড টেক’নামে একটা সফটওয়্যার কোম্পানির কর্ণধার ছিলেন তিনি। এখানে আইটির উপর বিশেষ কোর্স করে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী আমেরিকার বিভিন্ন নামী কোম্পানীতে উচ্চ বেতনে চাকরি করেছেন। মির্জা হুদা নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘বিডিনিউজ.লাইভ’নামের একটি বাংলা অনলাইন পোর্টালের এডিটর ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
মির্জা হুদার বড়বোন ফিওনা মির্জা টেলিফোনে নিউ ইয়র্ক মেইলকে জানান, শিশু সারাফ এখনও জানে না যে তার বাবা নেই। সে যখন জিজ্ঞেস করে “বাবা কখন আসবে, এত দেরি হচ্ছে কেন?” তার কথার কোনো জবাব দিতে পারি না আমরা কেউ। বোঝানোর জন্য যখন বলি “তোমার পাপা আকাশের স্টার হয়ে গেছে, এখন আসবে না। তখন সে বলে-”পাপার কাছে ঘরের চাবি আছে তো? তা না হলে পাপা ফেরার সময় ঘরের দরজা খুলবে কিভাবে।”
তিনি বলেন, আমরা সবসময় যাই ভাইয়ের বাসায়। একবার ভাবিকে সান্তনা দেই, আরেকবার বাচ্চাদের। বাবা হারা বাচ্চা দুইটার মুখের দিকে তাকানো যায় না...। এ পর্যন্ত বলেই থেমে যান ফিওনা মির্জা। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ভাই হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়েছেন তিনি। তিনি সবাইকে সান্তনা দিচ্ছেন কিন্তু তাকে সান্তনা দেবার কেউ নেই।
মির্জা হুদার বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। বাড়ির তিনজন মানুষ প্রিয়জনকে হারিয়ে নির্বাক প্রায়। হাসি আনন্দ যেন মিলিয়ে গেছে তাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য। নিস্তব্ধ সেই বাড়িটি থেকে মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। ইট-পাথরের দেয়াল পেরিয়ে সেই শব্দ হয়তো কারো কানে পৌঁছায় না। স্বজনরাই কেবল কাঁদে ডুকরে ডুকরে, কাঁদবে অনন্তকাল!