॥ নুরএলাহি মিনা॥
‘মা’
“নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।”
আজ থেকে বত্রিশ বছর আগের কথা। রাজেন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। বাড়ির পাশ দিয়ে তখন এফোঁড়-ওফোঁড় করা বিশ্বরোড ছিলনা। ছিলনা আধুনিক রেল লাইন। ফরিদপুর থেকে বাড়ি আসার জন্য প্রথমে আসতে হতো মধুখালী রেলওয়ে জংশন; তারপর ধরতে হতো ভাটিয়াপাড়ার ট্রেন। ট্রেন মিস করলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার হতো অপেক্ষায়। তখন বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। তাই অগ্রিম চিঠি দিয়ে না জানালে মা-বাবা জানতেনও না যে আমি বাড়ি আসছি।
ঠিক এরকমই একটি দিন। ফরিদপুর থেকে রওয়ানা দিয়ে মধুখালী এসে যথারীতি ট্রেন ফেল করলাম। পরের ট্রেন ধরে যখন বাড়ি পৌঁছুলাম তখন রাত দ্বি-প্রহর। ব্যাসপুর স্টেশন থেকে কৃষ্ণপক্ষের নিশুতি রাতে কিভাবে বাড়ির উঠোন পর্যন্ত এসে পৌঁছূলাম, ভাবতে এখনও গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। যতদুর মনে পড়ে তখন মে মাসের মাঝামাঝি। শান্ত, স্থির গ্রাম। নিকষ কালো অন্ধকার চারিদিকে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়াতেই রাজ্যের বিহ্বলতা ঘিরে ধরল আমাকে। হাতের ব্যাগটি উঠোনের মাঠিতে ছেড়ে দিলাম, অথবা এমনিতেই পড়ে গেল। শব্দ হলো কিনা বুঝিনি, তবে ঘরের কোনের আমগাছ থেকে একটি বাদুর উড়ে গেলো। বাদুর ওড়ার সাথেই একটি পাকা আম এসে পড়ল প্রায় আমার পায়ের কাছে। কন্ঠ দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছেনা। শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছে ব্যাসপুর স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত আসার পথ। কাগদী ও সড়ইডাঙ্গার বিল, নির্মম হত্যার শিকার যুবকের কবর, হিরণ্যকান্দির ঘন বন, বাজারের বটগাছ –এমন সব শরীর হীম হয়ে যাওয়া ভয়ের স্থানগুলো যখন পার হয়েছি, তখনতো ভয় লাগেনি! কিন্তু এখন কেন দেখছি –বিলের গভীর জলে সোনার নাও পবনের বৈঠা; এখন কেন মৃত্যু যুবকের অতৃপ্ত আত্মা আমার দিকে এগিয়ে আসছে; কেনইবা দেখছি ঘন বনের মাঝে উজ্জ্বল একটি আলো জ্বলেই নিভে গেল; বাজারের বটগাছ থেকে গায়ের উপর তরল নির্গত করল কি কেউ? …উঠোনে ব্যাগ ফেলে দেওয়ার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মনের পর্দায় এমন সব প্রেতকান্ড ঘটে গেল। ‘মা’ বলে ডাকার শক্তিও যেন হারালাম, মনে হলো মাটিতে বসে পড়ি। কিন্ত মূহুর্তেই ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম। মা উদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে আসতে আসতে বলছেন, “কে, নুরএলাহি?”
মা ব্যাগ হাতে নিলেন, ভৎর্সনা করতে করতে ঘরে ঢুকলেন; নিভূ নিভূ হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিলেন। ততক্ষণে বাবা উঠে গেছেন। এতরাতে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে কিভাবে আমি এলাম, কেনইবা আমাকে এমন হঠাৎ আসতে হলো, এমন হাজারটা প্রশ্ন তাঁদের। দোয়া পড়ে মা আমার মাথায় ফুঁ দিলেন; তালের পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আমি চুপ করে জলচৌকিতে বসে আছি। ততক্ষণে ভাই-বোনগুলোর গভীর ঘুমেও ছেদ পড়েছে। আমাকে ঘিরে রয়েছে ওদের কৌতুহলী চোখ। মা বাবার হাতে তালপাখাটি দিয়ে আমার খাবার বন্দোবস্ত করেতে গেলেন।
…বত্রিশ বছর আগের সেই দিন আমি প্রায়ই দেখি। ভাবলেই মা চোখের সামনে ধরা দেয়। এমন একটি রাতও মনে পড়েনা যে রাতে আমি স্বপ্নে মা কিংবা বাবা অথবা দু’জনকে দেখিনি। আমার আত্মার সাথে মিশে থাকা আত্মাকে কেমন করে আলাদা করবো; সে ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটিই যে আমার নেই।
আর কয়েক ঘন্টা পরেই বাংলাদেশে ২৭ জুন। ২০০৯ সালের এই দিনে অর্থাৎ ২৭ জুন আমরা মা’কে হারাই। আর এর মাত্র সাড়ে চার মাস আগে হারাই বাবাকে। মা-বাবা হারানোর বেদনা কেবল সে-ই বুঝে, যিনি হারিয়েছেন। আর যার মা আছে তাঁর আছে জান্নাত।
ঢাকায় আসার পর প্রথমবারের মতো যখন নির্মলেন্দু গুণের হুলিয়া কবিতাটি শুনলাম; অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সকল মা-ই সন্তানের অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী কাটায়, যদি কিনা তার বুকের ধন বাড়ির বাইরে থাকে।
“..আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে ডাকলুম,— “মা’৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো”।
..কবিতাটি পড়তে পড়তে মনের অজান্তেই সেই রাতটি আমার মনের দৃশ্যপটে জীবন্ত হয়ে ধরা দিল। আমি ভেবে অবাক হই, উঠানে দাঁড়াতেই মা টের পেয়েছিলেন যে আমি এসেছি। তার মানে, মা সন্তানের পায়ের শব্দ টের পান; তার মানে মা সন্তানের গায়ের গন্ধ টের পান।
আমিসহ আমার ভাইবোনদের এমনই অগণন স্মৃতি রয়েছে মাকে নিয়ে। খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে ভাই-বোনদের একসাথে খেতে দিতেন মা। আজ মা নেই, বাবাও নেই। শুধু রয়েছে হিরন্ময় স্মৃতিগুলো। পিছন ফিরে তাকালেই দেখি, আমাদেরকে মানুষ করতে মা-বাবার জীবন যুদ্ধ। অথচ হাজারো টানাপোড়েনের সেই দিনে বার বার ফিরে যেতে চায় মন। যদি আবার ফিরে পেতাম শৈশব, যদি আবার পুকুর জলে ঘন্টার পর ঘন্টা কটিয়ে চোখ লাল করে ফিরতে পারতাম, যদি আবারও মায়ের বকুনি খেতাম!
তা-কি আর হয়! জীবন আর মৃত্যুর মাঝে বিস্তর ব্যবধান। সবই কেবল স্মৃতি। যা আকড়ে ধরে মাকে খুঁজি আজও-
“..গা’টি গরম হলে
মা সে চোখের জলে
ভেসে বলে, ‘ওরে যাদু কি হয়েছে বল’।
কত দেবতার ‘থানে’
পীরে মা মানত মানে-
মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।
যখন ঘুমায়ে থাকি
জাগে রে কাহার আঁখি
আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।
তাই কত ছড়া গানে
ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম’।
(নজরুল, মা)
(যাঁদের মা বেঁচে নেই লেখাটি তাঁদের জন্য উৎসর্গকৃত)
———————
লেখক: মো: নুরএলাহি মিনা
প্রথম সচিব, জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ি মিশন
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
২৬ জুন ২০২০