পি.আর. প্ল্যাসিড, জাপান:
ছোট বেলা থেকে বয়স বাড়ার সাথে অনেক কিছুই করেছি জীবনে। ইচ্ছে আছে এসব ঘটনার কথা লিখে রাখার।
জীবনের প্রথম ঘটে যাওয়া বিষয় গুলো মনে দাঁগ কাটে বেশি। প্রথম ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার কথা মনের ভিতর স্থায়ীত্ব হয়ও বেশি। ঘটনাগুলোকে সাহিত্য রস দিয়ে চেষ্টা করবো পাঠ উপযোগী করতে। আপনাদের ভালো লাগলে আমার লেখা স্বার্থক মনে করবো।
জীবনের প্রথম চিঠি লিখেছিলাম লন্ডন প্রবাসী বড় ভাইকে-
চিঠি ছিল একসময় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এমন দিন আসবে যখন হয়তো মানুষ যাদুঘরে গিয়ে চিঠি দেখবে। এখনই যে তা হতে চলেছে তার প্রমাণ তো মিলছেই বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে। একসময় চিঠি লিখে প্রেরকের কাছে পাঠানোর জন্য হলুদ একধরনের খাম ছিল, এই খামকে আমরা এনভেলপই বলতাম। দেশের অভ্যন্তরে এই এনভেলপের মাধ্যমে চিঠি প্রেরকের নিকট চিঠি পাঠানো হতো। বিদেশের বেলায় সেই চিঠি পাঠানো হতো নীল খামের ভিতর করে। আর ভালোবাসা করতে প্রেমপত্র যেত হয়তো হাতে হাতে, কখনও বইয়ের ভিতর করে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে। সেই সময়ের কথাই বলছি।
আমি তখন ছোট। বড়ভাই লন্ডন প্রবাসী। বাড়ি থেকে আমরা চিঠি লিখতাম বড় ভাইকে। বড়ভাইও লিখতেন সেই একইভাবে। মাঝে মধ্যে লন্ডন থেকে পরিচিতজনদের কেউ দেশে আসলে বড়ভাই তাদের হাতে চিঠি লিখে পাঠাতেন। আমরা হয়তো তা আনতে গিয়েছি অনেকদূরের পথ পেরিয়ে। কিংবা লন্ডন প্রবাসী বাড়িতে এসে চিঠি সহ ভাইয়ের পাঠানো জিনিসপত্র দিয়ে যেতেন।
যতদুর মনে পড়ে সুইজারল্যান্ডের কোনো এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পত্রমিতালী করেছি। আমার মত অনেকেই তা করেছে। করলেও আমি নিজে সেই চিঠি কখনও পড়িনি। উত্তরও লিখেছি অন্যের সহযোগিতায়। বলতে পারি নামটাই শুধু আমার ব্যবহার করা হতো। বড় হয়ে ধারনা করেছি সেসব করে ওরা হয়তো বিদেশের কোনো ফান্ড আদায় করতো।
সে সময় বিদেশি কোনো পত্রমিতার কাছ থেকে চিঠি পেলেও নিজে কখনও চিঠি লেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি সজ্ঞানে যদি বলি, তাহলে প্রথম চিঠি লিখেছি ১৯৭৫ সনের ১৫ আগষ্ট তারিখে। যতটা মনে পড়ে, বাবা বাজার থেকে এরোগ্রাম কিনে এনেছিলেন কয়েকটা। এটাও নীল রঙ্গের হয়। তবে এটার আকৃতি কি করে বলি বুঝতে পারছি না। লম্বা কাগজ, এটার উপর চিঠি লিখে ভাজ করে উপরে প্রেরক এবং প্রাপকের ঠিকানা লিখে পর্যাপ্ত খরচের ডাকটিকিট লাগিয়ে পোস্টে বক্সে ভরে দিলেই হয়ে যেতো। ডাক পিয়ন সেই চিঠি ঢাকার জিপিওতে নিয়ে এসে সেখান থেকে পাঠিয়ে দিতো নির্ধারিত ঠিকানার উদ্দেশ্যে। তবে এই এরোগ্রামে চিঠি লেখা হতো কেবল বিদেশের বেলাতেই।
আমার এই চিঠি লেখার কিছুদিন আগে বড়ভাই দেশে এসে বিয়ে করে তার স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি) রেখে গেছেন। ফিরে যাবার পর বাড়ি থেকে বেশ দেখেছি বড়ভাইকে এই এরোগ্রামে চিঠি লিখতে। লন্ডন থেকে ভাইও মাঝে মধ্যে এরোগ্রামে চিঠি লিখতেন বৌদিকে। দেখা যেতো এক এরোগ্রামের মধ্যে কমবেশি সবাইকে অল্প অল্প করে লিখতেন। তার উত্তরও দেওয়া হতো সেই ভাবেই। ১৪ আগষ্ট বাবার বাজার থেকে আনা এরোগ্রামে বৌদি, বাবা-মা চিঠি লেখার পর আমার জন্য একটা স্পেস বাকী রেখেছিলেন। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমাকে সেটাতে কিছু লিখতে বললে আমি কিছু কথা লিখেছিলাম, নিজের মত, মনে যা ইচ্ছে হয়েছিল তাই।
সেদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর রেডিওতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার সংবাদ শুনে সত্যিই হতভম্ব হয়েছি। তাই চিঠিতে অনেক কিছু লেখার থাকলেও বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হবার সংবাদটি বড়ভাইকে লেখার গুরুত্ব দিয়ে লিখেছিলাম কয়েক লাইনের মধ্যে। চিঠিটা ছিলা এমন-
পরম পূজনীয় দাদা,
আমার নমষ্কার নিও। আমরা বাড়িতে সবাই ভালো আছি। আশা করি তুমিও ভালো আছো।
পর সমাচার এই যে, তোমার প্রাণ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হইয়াছে।--ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার চিঠি লেখা শেষ হলে বাড়ির সবাই সেই চিঠি পড়লো। যখন দেখেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা উল্লেখ করেছি তখন সেই চিঠি আর পোস্ট করা হয়নি অজানা এক ভয়ে। বাবার ভয় ছিল যদি আবার সেই চিঠি খুলে দেখা হয় তাহলে বিপদ হতে পারে, তাই।
দীর্ঘ সময় মনের মধ্যে এই চিঠির বিষয়টি লালন করেছি। ভেবেছিলাম, কখনও যদি সুযোগ হয় তাহলে আমি লিখবো কোথাও জীবনের প্রথম লেখা এই চিঠি প্রসঙ্গে। আজ মনে হচ্ছে পূর্ণ হলো সেই আশা।
এরপর বয়স বৃদ্ধির সাথে বহু জনকে চিঠি লিখেছি। এতো চিঠি লেখার পরেও আফসোস রয়েই গেল, লন্ডন প্রবাসী বড়ভাইকে উদ্দেশ্য করে লেখা আমার জীবনের প্রথম চিঠি অজানা ভয়ে পোস্ট না করার কারণে প্রেরকের কাছে আর পৌঁছায়নি, পৌঁছানোর আর কোনো সম্ভাবনাই নেই যে।