তুহিন সানজিদ, নিউ ইয়র্ক:
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনী ও ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামী মেজর (বরখাস্ত) রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরৎ পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করার ১৪ বছর পর অ্যাটর্নি জেনারেলের বিশেষ নির্দেশে এই নথি তলব করা হয়েছে। গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেসনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা করে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরৎ দেবার অনুরোধ জানান এবং এ সংক্রান্ত একটি ফাইল তার হাতে তুলে দেন।
বাংলাদেশের সেই আবেদনের কারণেই ট্রাম্প প্রশাসন রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক এ্যাসাইলাম বাতিল করে তাকে দেশে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে তার আইনজীবী।
মামলা সচল হওয়ার পর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটা হবে আমেরিকার ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের যঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত এই খুনীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা সহজ হবে। তাঁর ভাগ্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের হাতে।
নিউ ইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, খুনী রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারলে সেটা হবে বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বাধীন সরকারের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক বিজয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ”পলিটিকো” তাদের অনলাইনে শুক্রবার সকালে
”হি থট হি হ্যাড এ্যাসাইলাম, নাও হি কুড ফেইস এ ডেথ সেন্টেন্স” শিরোনামে সর্বপ্রথম এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবী আ্যাটর্নি মার্ক ভ্যান ডার হোট আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, অনেক বছর আগে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়া একটি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকে পুনরায় সামনে আনার কারণে অন্যান্য আবেদনকারীদের মধ্যেও আতংক কাজ করতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনী মেজর (বরখাস্ত) রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সেক্রামেন্টো থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরের শহর কনকর্ড সিটির হাকেলবেরি ড্রাইভ এলাকায় স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করছেন। এখানে তার একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে।
বারবার স্থান বদল করে ২০১৫ সালে বিলাশবহুল বাড়ি কিনে কনকর্ডে বসবাস শুরু করেন। এখানে তার ছেলে রূপম চৌধুরীরও মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাড়ি আছে। এর আগে ক্যালিফোর্নিয়ার সেক্রামেন্টো, কলোরাডো, ইলিনয় এবং মিসৌরিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বসবাস করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার পর ১৯৭৬ সালে কালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মেজর রাশেদ চৌধুরীকে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তিনি কেনিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসেও কাজ করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর এ খুনিকে চাকরি থেকে অব্যহতি দিয়ে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দেশে না ফিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো চলে যান। পরে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। ১০ বছর পর ২০০৬ সালে তার আবেদন গ্রহন করেন আদালত।
২০০৮ সালে আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা করে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরৎ দেবার অনুরোধ জানান এবং এ সংক্রান্ত একটি ফাইল তার হাতে তুলে দেন। এর দুই মাস পর ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়ের কপিসহ এই বিচারে রাশেদ চৌধুীর ব্যাপারে যাবতীয় কাগজপত্র চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার কিছুদিনের মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সব কাগজপত্র পাঠায় বাংলাদেশ।
পরে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেওর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে সোপর্দ করার অনুরোধ জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এ মোমেন। এরপর টেলিফোনেও অনুরোধ জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পাশাপাশি ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও এ ইস্যুতে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেছেন ড. মোমেন।
সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে এমনটিই মনে করছেন সবাই।
এর আগে সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ২০০৭ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদকে বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। পরে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আরেক খুনী বরখাস্তকৃত রিসালদার মোসলেহউদ্দীনের এ্যাসাইলাম আবেদন নাকোচ করে তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়।