logo
আপডেট : 16 January, 2021 22:06
বিথির ক্রিকেট একাডেমির পাশে এবার নিউইয়র্কের জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস খন্দকার

বিথির ক্রিকেট একাডেমির পাশে এবার নিউইয়র্কের

জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস খন্দকার

নিউইয়র্কের জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস খন্দকার এবং নারী ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা বিথি

বিশেষ প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক: রংপুরের সেই ক্রিকেটার বিথির পাশে দাঁড়িয়েছেন নিউইয়র্কের মানবতার দূত খ্যাত জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস খন্দকার। দেশের প্রথম নারী ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আরিফা জাহান বিথির স্বপ্ন পূরণে নিজস্ব একাডেমি ভবন তৈরি করে দেয়ার ঘোষনা দিয়েছেন তিনি। আর এই সুখবর শুনে আনন্দে আত্মহারা বিথি ও তার একাডেমির মেয়েরা।

বিথির স্বপ্নটা ছিল অন্যরকম। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেশের মুখ উজ্জল করতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মায়ের মুদি দোকান দেখাশুনার ফাঁকে পড়াশুনা করে মাধ্যমিকের গন্ডি পার হয় বিথি। তারপর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ক্রিকেটার হবার। ভর্তি হন স্থানীয় এক কোচের কাছে। স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উঠা শুরু হয় তার। সুযোগ পান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে। ওরিয়ন স্পোর্টিং ক্লাব, কলাবাগান ও রায়েরবাজারের হয়ে অসংখ্য টুর্নামেন্টে অংশগ্রহন করেন তিনি ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে। ব্যাটে-বলে দুদিকেই পারদর্শি তিনি। তবে হঠাৎ অনাকাঙ্খিত বিপর্যয় নেমে আসে তার জীবনে। অজানা এক অসুখের কারণে ক্রিকেট থেকে ছিটকে যান প্রতিভাবান এই নারী ক্রিকেটার। নাক দিয়ে ঘনঘন রক্ত পড়ার কারণে চিকিৎসকরা তাকে ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। ক্রিকেট না ছাড়লে আর রক্ত পড়া বন্ধ হবে না এবং এক সময় ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে বলে জানিয়ে দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। সম্ভাবনাময় এই ওপেনার ব্যাটসম্যান ২০১৭ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন।

ক্রিকেটের বাইরে পারিবারিক জীবনও তার অন্ধকারাচ্ছন্ন। পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল কিশোরী বয়সেই। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছে বারবার। গায়ের রং কালো, চেহারা ভালো না তাই বিয়ে ভেঙ্গে গেছে দুইবার। মাজপথ থেকে ফিরে গেছে বরযাত্রী। হঠাৎ অজানা রোগে হারিয়ে গেছে জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ক্রিকেট। শৈশব থেকে জীবনের বাঁকে বাঁকে এভাবে একেরপর এক বিপদ, সমস্যা আর ভয়ংকর অভিজ্ঞতাই তার সবসময়ের সঙ্গি। তবে কোনো কিছুই তাকে স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা হতে পারেনি, দুরে সরাতে পারেনি স্বপ্নের ক্রিকেট থেকে। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অন্যভাবে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সেই কালো চেহারার কিশোরীই এখন দেশের প্রথম নারী ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা।

বিথির বাড়ি রংপুর শহরের নুরপুর এলাকায়। বাবা মফিজুল ইসলাম পেশায় হকার। ফেরি করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় মেশিনারী পার্টস বিক্রি করেন। তা থেকে যা আয় হয় তাতে সংসার চলে না। তাই বড় বোনের উপরই নির্ভরশীল বিথি। আর বিথির উপর নির্ভরশীল প্রায় সাড়ে ৩শ’ মেয়ে। যারা এই একাডেমিতে প্রশিক্ষন নিয়ে একদিন জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখছে।

২০১৯ সালের ২৬অেক্টোবর যাত্রা শুরু হয় দেশের প্রথম নারী ক্রিকেট একাডেমি “ওমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি” এর। ৩০টি মেয়ে নিয়ে প্রশিক্ষন শুরু করে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩শ’ মেয়ে প্রশিক্ষন নিচ্ছে এই একাডেমিতে। তবে মাঠের অভাবে নিয়মিত প্রশিক্ষন নিতে পারছে না মেয়েরা। স্টেডিয়ামে বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রম থাকায় বেশিরভাগ সময় বসে থাকতে হয় মেয়েদের।  

ইতিমধ্যে আঞ্চলিক তিনটি টুর্ণামেন্টে বিথির “ওমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি” চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ডিসেম্বরে দিনাজপুর বিকেএসপিতে এই একাডেমির ১৫জন মেয়ে পরিক্ষা দেয় এর মধ্যে ৭জন সেখানে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে। এটাকে প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে মনে করছেন বিথি।

দেশের ইতিহাসের প্রথম নারী ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা বিথি টেলিফোনে  জানান, এই একাডেমিতে মেয়েদের সম্পূর্ণ ফ্রি প্রশিক্ষন দেয়া হয়। তাই সরকার এবং সহৃদয়বান ব্যাক্তিদের সহযোগিতা খুব প্রয়োজন।

তিনি আরো জানান, নিউইয়র্কের জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস খন্দকারের সাথে সম্প্রতি তার পরিচয় হয়। আমাকে ফোন করে তিনি এমন একটি উদ্যাগের কারণে ধন্যবাদ জানান এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন। এই একাডেমির মেয়েরা দিনাজপুর বিকেএসপিতে পরীক্ষা দিতে যাবে শুনে মেয়েদের জার্সি এবং অন্যান্য খরচের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেন। ১৫জনের মধ্যে ৭জন মেয়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে সেখানে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে।

বিথি আরো জানান, ডা. ফেরদৌস খন্দকার ফোন করে আরো জানিয়েছেন তিনি একাডেমি ভবন তৈরি করে দেবেন। এই আনন্দ প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মেয়েদের প্রশিক্ষনের জন্য একাডেমি ভবন খুবই প্রয়োজন। প্রশিক্ষনার্থীদের ব্যাট-প্যাড রাখা, পোশাক পরিবর্তনসহ সবকিছুর জন্য নিজস্ব ভবন ছাড়া সম্ভব না। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিথি বলেন, ডা. ফেরদৌস খন্দকারের মতো সহৃদয়বান মানুষেরা এগিয়ে আসলে একদিন এই একাডেমির মেয়েরাই দেশকে নেতৃত্ব দেবে। ডা. ফেরদৌস খন্দকার তার ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে একাডেমির মেয়েদের পোশাক কিনে দিয়েছেন। এটা আমাদের কাছে অনেক বড় পাওয়া। 

ডা. ফেরদৌস খন্দকার নিউইয়র্ক মেইলকে জানান, সম্প্রতি আরিফা জাহান বিথির ক্রিকেট একাডেমি সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর আমি তার নাম্বার যোগাড় করে যোগাযোগ করি। তার জীবন কাহিনী শুনলে যে কেউ কষ্ট পাবে। তার জীবন কাহিনী শুনে আমিও চ্যালেঞ্জ নিলাম তার সাথে, তার চ্যালেঞ্জগুলো। তার খুব শখ মেয়েদের ক্রিকেট একাডেমি অনেকদুর নিয়ে যাওয়ার। ব্যাপারটি খুব অবাক হওয়ার মতো। নিজেই চলতে পারে না, কিন্তু ক্রিকেট একাডেমি নিয়ে স্বপ্ন তার আকাশ ছোঁয়া। তার পাশে দাঁড়ালাম। সম্প্রতি তার একাডেমির ৭জন মেয়ে দিনাজপুর বিকেএসপিতে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে। এটা খুশীর খবর। মেয়েগুলোর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছি। ছোট্ট ছোট্ট পিচ্চি মেয়েরা। ১৪-১৬ তাদের বয়স। নদী, সুখী আরো কয়েকজন। ওদেরকে কথা দিলাম যে পাশে আছি।  

হতদরিদ্র পরিবারের এই ছোট ছোট মেয়েরা স্বপ্নের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। এখান থেকেই তারা স্বপ্ন দেখে একদিন জাতীয় দলে খেলবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি নির্দিধায় রাজি হয়ে গেলাম তাদের স্বপ্নের ক্রিকেট একাডেমির ভবন তৈরি করে দিতে। কথা দিয়েছি তাদে স্বপ্নের সাথে থাকবো। তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসন ও অন্যান্যদের সাথে কথা বলেছি যদি এক টুকরো জমি কোথাও পাওয়া যায় তাহলে একাডেমি ভবন আমি তৈরি করে দেব। আমরা সবাই মিলে বিথিদের স্বপ্ন পূরণে হাত বাড়ালেই একদিন এই একাডেমির মেয়েরাই বিশ্বসেরা হয়ে উঠবে।