আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হলেই সংসদ সদস্যপদ চলে যায়। লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল চার বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন কুয়েতের আদালতে। কিন্তু দেশের বাইরের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হলে কী ঘটবে- সে বিষয়ে আইনগত স্পষ্টতা নেই। এ পরিস্থিতিতে পাপুলের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
আইন ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি এখন সংসদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। আর সংসদ প্রয়োজন মনে করলে বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর ছেড়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সংবিধানের ৬৬ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নৈতিক কারণেই পাপুলের সংসদ সদস্যপদ চলে যাওয়া উচিত। শুধু জাতীয় সংসদের পবিত্রতা নয়, বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গেও জড়িত। একজন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী আইন প্রণেতাদের সারিতে বসতে পারেন না।
বৃহস্পতিবার কুয়েতের আদালতে মানব ও মুদ্রা পাচারের অপরাধে চার বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য পাপুল। একইসঙ্গে তাকে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরপরই পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা।
সংবিধানের ৬৬ (২) ধারায় সংসদ সদস্যপদে থাকার অযোগ্যতার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। (ঘ) উপধারায় বলা হয়েছে, নৈতিক স্থলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যদি কেউ অন্যূন দুই কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়- তাহলে তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার বা পদে থাকার অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ক্রাইম ইজ ক্রাইম। সেটা বাংলাদেশে হোক বা কুয়েতে হোক। যেহেতু তিনি বিচার প্রক্রিয়ায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গেছেন, সেহেতু নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে তার সংসদ সদস্য পদে থাকার অধিকার নেই। বাংলাদেশের সংবিধানও সেটা সমর্থন করে না।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৬৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুই বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হলে তার সংসদ পদ বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে। তার (পাপুল) ক্ষেত্রেও আইনগতভাবে যা হওয়ার তাই হওয়া উচিত।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের স্পিরিট হচ্ছে কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি সংসদে থাকবেন না। এ কারণে দুই বছর দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য পদে থাকার অযোগ্যতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের এ স্পিরিট অনুযায়ী তিনি (পাপুল) সংসদে থাকার অযোগ্য হয়ে গেছেন। কারণ তিনি একটি বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
পাপুলের বিরুদ্ধে কোন প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দি মেম্বারস অব পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট, ১৯৮০ অনুযায়ী, কেউ যদি মনে করেন তিনি দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন এবং সেটি জাতীয় সংসদের স্পিকারকে অবহিত করেন; তখন স্পিকার যদি ওই অভিযোগের যথার্থতা আছে বলে মনে করেন তবে তিনি বিবেচনার জন্য ইসির কাছে পাঠাবেন। ইসি উভয়পক্ষের শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা আবার স্পিকারকে জানাবেন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সরাসরি কিছু করণীয় নেই। জাতীয় সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে। তারা সিদ্ধান্ত নিলে আমরা ওই আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট জারি করব। আর যদি জাতীয় সংসদ মনে করে, এখানে আইনের ব্যাখ্যার প্রয়োজন তখন নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলবে। তখন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে এবং সেটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ওই সিদ্ধান্ত আমরা জাতীয় সংসদকে জানিয়ে দেব।
তবে বিষয়টি সংসদেই সুরাহা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত একটি কমিটি রয়েছে। কমিটির উদ্দেশ্য হলো- সংসদের মর্যাদা যদি কেউ হানি করে তাহলে তিনি সংসদ অবমাননার দায়ে দোষী হবেন এবং ওই কমিটির মাধ্যমে তারা ব্যবস্থা নিতে পারেন। দুর্ভাগ্যবশত গত ৩০-৪০ বছর ধরে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আমরা দেখিনি।
তিনি বলেন, যদিও আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের অনেকেই দুর্নীতি, দুষ্কর্ম, অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। তারা সংসদের মর্যাদাহানি করছেন। কিন্তু ওই কমিটিকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ভারতে একবার ৫-৬ জন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অর্থাৎ ইচ্ছাটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা।