মিয়ানমারের পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হয়ে উঠছে। সেখানে শিগগিরই সিরিয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। দেশটি ধীরে ধীরে সেদিকেই এগোচ্ছে।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটির ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান। মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, মিয়ানমারে সম্ভবত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটছে। সিরিয়ার মতো ‘বিধ্বংসী ও সর্বাত্মক সংঘাতে’র দিকে যাচ্ছে দেশটি।
গত পহেলা ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, তাতমাদো। এরপর থেকে চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে দেশটিতে।
বিক্ষোভ-আন্দোলনের মুখে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গেছে। সেনাবিরোধী বিক্ষোভে প্রতিদিন তাজা বুলেট ছুড়ছে সেনা-পুলিশ। এতে সাত শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে।
বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে। এক বিবৃতিতে মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, অভ্যুত্থানের পেছনে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের উচিত নিজেদের লোকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমন অভিযান ও হত্যা বন্ধ করা।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মিয়ানমারের পরিস্থিতি পূর্ণ সংঘাতে দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। সিরিয়ায় এবং অন্যান্য জায়গায় অতীতে যেসব মারাত্মক ভুল হয়েছে তা পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয় দেশটির।’
এদিকে জান্তাদের অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও মোটেই দমছে না অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীরা। হত্যাযজ্ঞ এড়াতে প্রতিরোধ-বিক্ষোভের নতুন নতুন কৌশল বের করছে। আন্দোলন-সংগ্রামের দীপ্ত প্রত্যয় ব্যক্ত করে তারা বলছে, ‘আমরা কখনই নতজানু হব না’।
পাঁচ দিনের নববর্ষের ছুটিতে নতুন করে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে আয়োজকরা। মঙ্গলবার শুরু হয় পাঁচ দিনের নববর্ষ উৎসব।
‘থিংগান’ নামে পরিচিত এ ছুটিতে নেতাকর্মীরা প্রতীকী বিক্ষোভ করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন। ফেসবুকে ধর্মঘট সহযোগিতা কমিটির বিক্ষোভ গ্রুপের নেতা আই থিনজার মাং বলেন, ‘সামরিক কাউন্সিল থিংগানের মালিক নয়, মানুষের ক্ষমতা মানুষের হাতে।’
থিংলানের এ ছুটিতে ফুটপাথগুলোতে লাল রং ছিটিয়ে, রাস্তার ওপর নানা ফুলের টব সাজিয়ে সেগুলোতে আগামী দিনের কর্মসূচির জানান দিচ্ছেন তারা।
ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার এক প্রতিবেদনে বলেছে, মার্চ থেকেই তাদের বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন আর প্রতিবাদের ভাষায় যোগ হতে থাকে নতুন নতুন মাত্রা।
জাতিগত পোশাকে এবং ফুল ও জলের বোতল ধারণকে ওরা বলছিলেন, ভোরের বসন্ত ফুলের ধর্মঘট। গোলাপ এবং জলের বোতলগুলো গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনে তাদের পতিত কমরেডদের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন তারা।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ‘ফুল ধর্মঘট’ দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল এবং এতে সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া ক্রমশ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
এখন পর্যন্ত ৭শ’রও বেশি মানুষ নিহত হওয়ায়, বিক্ষোভকারীরা কৌশল পরিবর্তনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন। দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তারা বলছেন, ‘এ বিপ্লবে আমাদের জয় হবেই। আমরা আর মাথা নোয়াতে রাজি নই। পারলে বুকের ওপর গুলি চালাও।’
মিয়ানমারে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতার মসনদে বসা সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি। গত আড়াই মাসে দেশটির সর্বস্তরের মানুষ উলটো তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে রাজপথে। আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনও আদায় করতে পারেনি জান্তা সরকার। উলটো একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জুটেছে কপালে।
সব মিলিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপের মধ্যে আছে জান্তা সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে খুব বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা জান্তা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিশেষ করে ‘একা একা’ অর্থনৈতিক ধস সামাল দেওয়া তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে গৃহযুদ্ধের চক্করেও পড়ে যেতে পারে এশিয়ার এই দেশটি। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে জানিয়েছে যে চলতি অর্থবছরে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ফিচ সলিউশনস’ বলছে, ১০ শতাংশ নয়, মিয়ানমারের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অদিত্য মাথু বলেন, ‘মিয়ানমারের মতো গরিব রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ কমে যাওয়া অবশ্যই তাদের জন্য অশনিসংকেত।’