logo
আপডেট : 7 May, 2021 08:23
সরকারের কাছে কি মুচলেকা দিয়ে লন্ডন যাচ্ছেন “আপোষহীন” খালেদা জিয়া?

সরকারের কাছে কি মুচলেকা দিয়ে লন্ডন যাচ্ছেন “আপোষহীন” খালেদা জিয়া?

তুহিন সানজিদ: দুর্নীতির দায়ে আড়াই বছর জেল খেটে সরকারের “দয়া”য় মানবিক বিবেচনায় মুক্তি নিয়ে “আপোষহীন” বিশেষণটা হারিয়েছেন আগেই। এবার মুচলেকার কোন শর্তে দস্তখত দিয়ে লন্ডনে ছেলের কাছে চলে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া? এমন প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সংবাদমাধ্যম এমনকি সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। 
শহরের অলিগলি, চায়ের দোকানের আড্ডায় এখন একটাই আলোচনা-খালেদা জিয়া কি আর দেশে ফিরবেন নাকি তারও পরিণতি হবে মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে পালিয়ে থাকা বড় ছেলে তারেক রহমানের মতো? ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তত্বাবধায়ক সরকারের সময় তারেক রহমান জামিনে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর গোপনে লন্ডনে পাড়ি জমান। চিকিৎসা শেষে দেশের ফিরে আসার মুচলেকা দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। একই পথ বেছে নিলেন তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
১০ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপারসনের করোনার উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষার পর করোনা পজেটিভ রেজাল্ট আসে। তার বাসায় অবস্থানকারী ১৪ জনের মধ্যে ৮ জনই করোনা আক্রান্ত ছিল। বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেয়ার সময় দ্বিতীয় দফায়ও করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে। এরপর ২৭ এপ্রিল ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৭৬ বছর বয়ষ্ক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। সেখানে নন-করোনা ইউনিটে চিকিৎসা চলাকালীন করোনা পরবর্তী বিভিন্ন জটিলতা এবং শ্বাসকষ্টের কারণে ৩ এপ্রিল তাকে সিসিইউতে নেয়া হয়। 
৫ এপ্রিল রাতে ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। পরদিন সেই আবেদন পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে। তার ব্যাপারে সরকারের পজেটিভ মনোভাব আছে বলেই ”মানবিক বিবেচনায়” তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। 
খালেদা জিয়ার পরিবার ও দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আদালত এবং সরকারের অনুমতি পেলেই লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে অসুস্থ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। এজন্য চাটার্ড ফ্লাইট রেডি রাখা হয়েছে। ছোটভাই শামীম এস্কান্দার, কাজের মেয়ে ফাতেমাসহ পরিবারের ৬ সদস্য যাচ্ছেন তার সাথে। 
তবে ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ”মানবিক” বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিলেও কঠিন শর্তের মুচলেকায় সই করেই দেশ ছাড়তে হবে একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলটির প্রধানকে। বিদেশে অবস্থানকালে রাজনৈতিক বক্তব্য না দেয়া, কোনো প্রকার রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকা, সরকার এবং দেশের স্বার্থের পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত না হওয়া, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র না করাসহ কমপক্ষে ৮টি কঠিন শর্তে স্বাক্ষর করতে হবে তাকে। আর এসব শর্ত ভঙ্গ করলেই মানবিক কারণে দেয়া জামিন বাতিল করা হবে। এরপর দেশে ফিরলেই আবারো গ্রেফতার হবেন দুটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আরো কয়েকটি নতুন মামলাও হতে পারে। 
সরকারের মুচলেকার শর্ত মেনে রাজনীতি থেকে নিজেকে দুরে রেখে চুপ থাকতে হবে নয়তো বাকী জীবনটা লন্ডনেই কাটাতে হবে। এছাড়া একসময়ের “আপোষহীন” নেত্রীর সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। 
বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউ ইয়র্ক মেইলকে জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো না। করোনা পরবর্তি বিভিন্ন জটিলতার কারণে তাকে সিসিইউতে নেয়া হয়েছে। সেখানকার দায়িত্বরত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এরপর থেকে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আদালত এবং সরকারের শর্ত মেনেই বিএনপি চেয়ারপারসন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসবেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না। তবে দলের ভবিষ্যত কর্মকাণ্ড নিয়ে ঘরোয়াভাবে বড় ছেলে তারেক রহমানের সাথে নিশ্চয়ই আলোচনা করবেন। বিএনপির সিনিয়র এই নেতা আরো বলেন, রাজনীতির চেয়ে খালেদা জিয়ার এখন উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। 
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলের ভবিষ্যত এবং রাজনৈতিক জীবন বিসর্জন দিয়েই সরকারের কঠিন শর্তের মুচলেকায় সই করে দেশ ছাড়ছেন বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর দেশ ছাড়ার সাথে সাথেই একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপির ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। কারণ দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি তার বড় ছেলে ১৪ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। আর তিনিও লন্ডনে নির্বাসনে গেলে অসংখ্য মামলায় জর্জরিত দলের নেতা-কর্মিদের মনোবাল ভেঙ্গে পড়বে। সরকার বিরোধী আন্দোলন তো দূরের কথা, দলীয় কোনো কর্মসূচিতেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। 
বিগত বছরগুলোতে শরিক দল জামায়াতে ইসলামির দেশব্যাপি সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত ছিল বিএনপিও। গত ১০ বছরে জামায়াত শিবির ছাড়াও বিএনপির কয়েক লাখ নেতা-কর্মি এসব মামলার আসামি। বছরের পর বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা পাননি ওইসব নেতা-কর্মিরা। সর্বশেষ কয়েক বছরে কোনো দলীয় কর্মসূচিতে আশানুরূপ উপস্থিতিও চোখে পড়েনি। দলের একমাত্র ক্ষমতাবান ব্যক্তি একাধিক হত্যা মামলার পলাতক আসামী তারেক রহমান লন্ডনে বসেই দল চালাচ্ছেন। তার ভুল সিদ্ধান্ত আর অতি খবরদারির কারণে দলের অনেক কাণ্ডারিই ক্ষোভে দুঃখে দল ছেড়েছেন। টাকা নিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে নোমিনেশন দেয়ায় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। আর দীর্ঘ দিনের ত্যাগী আর যোগ্য নেতারা নিজেদেরকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছে। 
মূলত তারেক রহমানের দুর্নীতি, ভুল সিদ্ধান্ত এবং নোমিনেশন বাণিজ্যের কারণে বিপর্যস্ত বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এই অবস্থায় খালেদা জিয়া দেশ ছাড়লে দলের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুঁকে দিয়ে যাবেন। দলের অস্থিত্বই থাকবে কি না এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ বিএনপির সিনিয়র নেতারাই। 
তবে খালেদা জিয়ার পারিবারিক একটি সূত্র বলেছেন, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর থেকেই মানসিকভাবে অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েছেন খালেদা জিয়া। একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে তারেকের দেশে ফেরার কোনো আশা নেই। বছর দুয়েক ধরে মাকে লন্ডনে নিজের কাছে নেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। 
৭৬ বছর বয়সে এসে জেলের ঘানি টানাও সম্ভব নয় দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত খালেদা জিয়ার। তাই রাজনীতি নয়, জীবনের বাকী সময়টা বড় ছেলে তারেক রহমানের সাথেই কাটাতে চান। আর তার এমন ইচ্ছার কারণেই বছর খানেক ধরে সরকারের সাথে দেন-দরবার করে যাচ্ছিল বিএনপি এবং তার পরিবারের সদস্যরা। পুত্রবধূ শর্মিলা দেশে এসেও তৎপরতা চালিয়েছিলেন শাশুড়িকে জেল থেকে মুক্ত করে লন্ডনে নিয়ে যেতে। কিন্তু সরকারের বেঁধে দেয়া কঠিন শর্তের সাথে দ্বিমত পোষন করে বেঁকে বসেন “আপোষহীন“ বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু অবশেষে সরকারের সাথে আপোষ করেই দেশ ছাড়তে হচ্ছে খালেদা জিয়ার।