সচিবালয়ে আটকে রেখে হেনস্তার পর ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ মামলায় গ্রেপ্তার এবং সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কারাগারে প্রেরণের বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদ চলছে।
বৃহস্পতিবার (২০ মে) এই মামলার জামিন শুনানী ছিল। কিন্তু মামলার জামিনের বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী রোববার (২৩ মে) ধার্য করেছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহর ভার্চুয়াল আদালত এ আদেশ দেন।
গত সোমবার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে গেলে সেখানে তাকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ তাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারি নথির ছবি তোলার অভিযোগ এনে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে গতকাল আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার পর বিকেলে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে নেওয়া হয় সাংবাদিক রোজিনাকে।
আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় রোজিনা ইসলাম সেখানে জড়ো হওয়া গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর করা প্রতিবেদনের জন্যই আমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। আমি অন্যায় আচরণের শিকার।’
রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও মামলা দিয়ে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংগঠন। তারা রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে। রোজিনাকে আটকের পর গত সোমবার রাতেই শাহবাগ থানা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন সাংবাদিকরা। এছাড়া গতকালও বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করে। আজও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে। একই ইস্যুতে গত কয়েকদিন ধরেই মানববন্ধন হচ্ছে সারা দেশে। কর্মসূচী পালিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও।
তদন্ত কমিটি গঠন মন্ত্রণালয়ের : রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটক করে রাখার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়টি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. সাইফুল্লাহিল আজমকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করা হয়। গত সোমবারের তারিখে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে।
কমিটির দুই সদস্য হলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. আবদুছ সালাম ও মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান মোল্লা।
মামলার বাদীর দপ্তর বদল : সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানীর দপ্তর বদল করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জনস্বাস্থ্য-১ অধিশাখা থেকে জনস্বাস্থ্য-২ অধিশাখায় পদায়ন করা হয়েছে তাকে। গত সোমবারের তারিখের অফিস আদেশে এই বদলি করা হলেও গতকাল সেটি প্রকাশ হয়। একই আদেশে আরও পাঁচ কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হয়েছে।
এদিকে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পরদিন বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) তা বর্জন করে।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচী ও বিবৃতি : রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সামনে আলাদা মানববন্ধনে রোজিনার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মানববন্ধনে সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সহসভাপতি এমএ কুদ্দুস বলেন, ‘রোজিনার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশা করি।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক খায়রুল আলম বলেন, ‘রোজিনা ইসলামকে মন্ত্রণালয়ে আটকে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এর নিন্দা জানাই। দায়ীদের বিচার চাই।’ রোজিনা জামিনে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে মানববন্ধনের শুরুতেই সাংবাদিকরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। ডিআরইউর সভাপতি মুরসালিন নোমানী বলেন, ডিআরইউর প্রায় দুই হাজার সদস্য রোজিনা ইসলামের পাশে আছেন। তিনি রোজিনা ইসলামের হত্যাচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হবে বলে উল্লেখ করেন। ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খান রোজিনা ইসলামকে যে আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই আইন বাতিলের দাবি জানান।
রোজিনার মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে রিপোর্টার্স এগেইন্ট করাপশন (র্যাকের) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আহম্মেদ ফয়েজ। এছাড়া জবি মিডিয়া ক্লাব, শরীয়তপুর সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামসহ (বিআইজেএফ) বিভিন্ন সংগঠন রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে।
১১ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বিবৃতি : রোজিনা ইসলামকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও মামলার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের ১১ বিশিষ্টজন। এ ঘটনা তাদের ‘বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছে’ বলেও উল্লেখ করেন। অবিলম্বে রোজিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও কারাগার থেকে মুক্তি দাবি করেন তারা। গতকাল দুপুরে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, অনুপম সেন, রামেন্দু মজুমদার, সারোয়ার আলী, মফিদুল হক, মামুনুর রশীদ, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, আবদুস সেলিম ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ : রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে রাজশাহীতে। নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন আরইউজের সভাপতি রফিকুল হক। এছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুর, নোয়াখালী প্রেস ক্লাবের সামনে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে, নেত্রকোনার মোস্তারপাড়া পৌরসভার সামনে নেত্রকোনার সাংবাদিক সমাজ, পঞ্চগড় শহীদ মিনারের সামনে, চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রেস ক্লাব চত্বরে, নীলফামারী জেলা শহরের বঙ্গবন্ধু চত্বরে, সুনামগঞ্জ পৌরশহরের আলফাত স্কয়ারে সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটি, খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে খুলনা প্রেস ক্লাব, বরিশাল শহরের আশ্বিনী কুমার হলের সামনে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, লালমনিরহাটের মিশন পাড়ায় স্থানীয় প্রেস ক্লাব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে সরাইল প্রেস ক্লাব, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাব, নারায়ণগঞ্জে নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঝিনাইদহে কর্মরত সাংবাদিকরা, লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে প্রথম আলোর বন্ধুসভা, ঠাকুরগাঁও শহরের চৌরাস্তায়, মাদারীপুর শহরের লেকপাড়ের শহীদ কানন চত্বরে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জেলা উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকরা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিবসহ দায়ীদের পদত্যাগ দাবি করা হয়।
এছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোট, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন রোজিনা ইসলামের মুক্তি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সচিবের পদত্যাগ দাবি করেছে।