logo
আপডেট : 19 September, 2021 23:34
কয়েক দফা ভূমিকম্প, ৭ মাত্রায় বিধ্বস্ত হতে পারে সিলেট
অমিতা সিনহা

কয়েক দফা ভূমিকম্প, ৭ মাত্রায় বিধ্বস্ত হতে পারে সিলেট

ছবি: নিউ ইয়র্ক মেইল

এক মিনিটের ব্যবধানে গেল সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে জোড়া মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে সিলেট। দশ দিন আগেই এক দিনে ৭ দফায় ভূমিকম্পের আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে  নেমে আসে অনেকেই। এমনই ভয়ঙ্কর আতঙ্ক যা বিগত সময়ে দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

পরপর মৃদু ভূমিকম্প কম্পন, বড় ধরনের আভাসের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যা রিখটার স্কেল ৭দশমিক ০ মাত্রায় সিলেট অঞ্চল বিধ্বস্ত হতে পারে বলে ধারণা করেছেন গবেষকেরা। 

জানা যায়, শুধুমাত্র ১৬৪৮ সালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চলের রূপ রেখা পাল্টাতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র একেবারে পাল্টে যায়। এর পরবর্তি সময় ১৮৯৭সাল ও ১৯১৮সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পন হয় সিলেট সংলগ্ন ভারতের আসাম রাজ্য ও শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৬মাত্রার আর ৮ দশমিক ৭ মাত্রার। ভয়ঙ্কর এই দুই ভূমিকম্পে বহুমানুষের প্রাণহানি, বাড়িঘর বিধ্বস্ত ও  ক্ষয়ক্ষতি হয়। যার সীমারেখা ছিলো ৩লাখ ৭৫হাজার ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। নতুন রূপে ছোট-বড় আকৃতির হাওর, বিল ও জলাশয় সৃষ্টি হয়। ওই সময়ের সেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে নাম দেওয়া হয় ভুইচাল বা বড় ভুইচাল। এরপর থেকে সিলেট অঞ্চলে বাংলো প্যাটার্নের বাসাবাড়ি তৈরির রেওয়াজ শুরু হয়। যাকে বলা হয় বাঁশ-কাঠ ও সিমেন্টের নির্মিত ঘর। যেখানে দেওয়া হয় না কোনো ভারী ইট-পাথর। বর্তমানে এর বিপরীতে বহুতল ইট-সিমেন্টের বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। 

ভূগর্ভস্থ দিক থেকে দেখা যায়, সিলেট থেকে মাত্র ২শ’ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ডাউকি ফল্টের অবস্থান। অপরদিকে সিলেটের নিকটতম  অবস্থানে আছে শাহবাজপুর ফল্ট। যার ফলে সিলেট ভূমিকম্পের জন্য খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গত ২৯ মে পরপর ৭/৮ দফায় ভূমিকম্পে সিলেট শহর কেঁপে উঠেছিল। ইতিহাসের পাতায় এটায় ছিলো একদিনে দফায় দফায় মৃদু ভূমিকম্প। যা এর আগে ছোট বড় ভূমিকম্প হলেও  পরপর ৭/৮দফার ভূমিকম্প ছিলো এটায় প্রথম। যার রিখটার স্কেল ছিলো সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ১ মাত্রার। এর দশ দিন ব্যবধানে গেল সোমবার সন্ধ্যায় এক মিনিটের ব্যবধানে দুইবার মৃদু ভূমিকম্প হয়। যার রিখটার স্কেল ছিলো ৩ দশমিক ৮ মাত্রার। 

এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের দক্ষিণসুরমার জালালপুরের কাদিরপুর। আর এর আগের পরপর ৮দফার ভূমিকম্প ছিলো সিলেটের জৈন্তাপুরে।

 খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের সিটি কর্পোরেশনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫শ’ ২৮টি ইট-সিমেন্টের তৈরি পাকা ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ২৪টি আছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে পরিত্যাক্ত ভবন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর সর্বোচ্চ বহুতল ভবন রয়েছে ২২তলা পর্যন্ত। 

সম্প্রতি ঘন ঘন ভূমিকম্পের ফলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ছাড়া শহর জুড়ে অভিযান শুরু হয়েছে ঝুঁকিপুর্ণ ভবনের। এছাড়া ভূমিকম্প থেকে জনসাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে ৮টি শপিংমল ১০দিনের জন্য বন্ধ রাখার  নির্দেশ দিয়েছে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তাছাড়া যারা ঝুঁকি নিয়ে দোকানপাট খোলা রেখেছে তাদের উপর জরিমানা ও মামলা করা হচ্ছে। সিলেট মহানগর জুড়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে এই অভিযান করা হচ্ছে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) উদ্যোগে। পুরাতন ঝুঁকিপূর্ণ ছাড়া নতুন ভাবে যেসব ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে ওই সব ভবনগুলোতে পর্যায়ক্রমে নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সিলেট জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্যবিভাগ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক অফিসগুলো। 

এ বিষয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সংবাদ বলেন, আগের  ঝুঁকিপুর্ণ ভবনগুলোকে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি আইনি জটিলতার জন্য। ভবনের মালিকেরা বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক এনে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে ‘ভবন ঝুঁকিমুক্ত’ বলে সনদ দেখায়। এতে করে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তবে সম্প্রতি দফায় দফায় ভূমিকম্পের কারণে শক্তভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ভূমিকম্প মোকাবেলায় সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তা চলমান আছে। 

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজ বলেন, সিলেটে একটি ভবন গড়ে তোলতে সিভিল সার্জন, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র দেখিয়ে সিটি কর্পোরেশনের অনুমনি নিতে হয়। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন নথিপত্র ঠিক আছে কিনা তা দেখে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। আমাদের এখানে দুই ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। কোনোটি মৃদু আর কোনোটি মাঝারি ক্যাটাগরির। সম্প্রতি যে ভূমিকম্প হচ্ছে এটা সাধারণত মৃদু। সম্প্রতি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা নতুন কমিটি তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে দক্ষ পাবলিক না পাওয়ায় কমিটির কার্যক্রম বাস্তবায়নে একটু পিছিয়ে আছি। খুব শীঘ্রই তা পূর্ণতা  হওয়ার পথে। 

সিলেট আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবু সাঈদ আহমদ বলেন,  ভূমিকম্পের কোনো সময় সীমা হয়না। যদি ধারে কাছে ভূমিকম্পন হয়, তাহলে কোন প্রকার সময় পাবেন না। আর দূরে হলে সময় পেতে পাবেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভূমির দুটি ওয়েব আছে একটি প্রাইমারী ওয়েব আর অপরটি দ্বিতীয় ওয়েব। প্রাইমারী ওয়েবে প্রতি সেকেন্ডে আসে ৮ কিলোমিটার বেগে। দ্বিতীয় ওয়েবে আসে প্রতি সেকেন্ডে ৬ কিলোমিটার বেগে। যদি দুই কিলোমিটার দূরে ভূমিকম্প হয় তবে এক সেকেন্ডের সময় পাবেন। আর ৮ কিলোমিটার দূরে হয় তবে দুই সেকেন্ডের সময় পাওয়া যাবে। তবে সিলেটের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রিখটার স্কেল ৭ দশমিক ০ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটে শতভাগ বিধ্বস্ত হতে পারে।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় একশত বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। তাই সিলেটের দফায় দফায় যে ভূমিকম্প কম্পিত হচ্ছে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনার আভাস দিচ্ছে। যা ৯০ ভাগ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা  প্রকাশ করেছেন।