চলচ্চিত্র এখনো মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। সিনে জগতের আলো ছড়ানো সিনেমা হলগুলো এক সময় মন ভুলানো নতুন নতুন সিনেমা প্রদর্শন করে দর্শক হৃদয়ের মণি কোঠায় জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে সেসব দিন।
বড় পর্দার সেটের সম্মুখে হল ভরতি হাজারো দর্শক শিস বাজিয়ে করতালি দিয়েছিলো। আর কখনো সামাজিক করুণ কাহিনী দেখে বুক ফাটা কান্নায় হলগুলো ভাসিয়ে দিয়েছিল সিনে প্রেমি দর্শকরা। অথচ আজ সেই সিনে প্রেমি দর্শকরা সিনেমা হলের কিনারাই পর্যন্ত দু’চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে না। নেই তাদের কোন নতুন নতুন সিনেমার প্রতি মোহ। যার ফলে সিনেমা হলের মালিকেরা আস্তে আস্তে করে সিনেমা হলের ব্যবসা গুঁটিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে শুধু একটি সিনেমা হল খোলা আছে। তাও যেকোন সময় বন্ধ করে বিলুপ্ত ঘটতে পারে।
কারণ হিসেবে জানা যায়, দেশের সংস্কৃতির সাথে মানান সই ছবি তৈরি না হওয়া, আধুনিক ডিজিটালের প্রভাব এবং বিনোদন কেন্দ্রে সুস্থ্য পরিবেশ না থাকায় প্রায় বন্ধের পথে অতিক্রম করে যাচ্ছে সিলেটের সিনেমা হল। এক সময় ছাড়া জাগানো রঙিন ভূবনের শ্রীহট্টের সাতটি সিনেমা হল আজ নিভু নিভু প্রদীপের মতো একটিতে শেষ নিঃশ্বাসের দিন যাপন করে যাচ্ছে। তাও যেকোন মুহুর্তে সিলেটের সবার প্রিয় একটি মাত্র সিনেমা হল নন্দিতাও গুটিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অথচ শ্রীহট্টের সাতটি সিনেমা হল - দিলসাদ, অবকাশ, নন্দিতা, রংমহল, লালকুঠির, মনিকা ও ক্যান্টলম্যান দর্শকদের কখনও কাঁদিয়েছে আবার কখনও আনন্দের জোয়ার ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় নানা বয়সের মানুষ নিজ নিজ দুঃখ কষ্টকে ভূলে গিয়ে একটু রঙিন বিনোদন জগতের স্বাদ নিতে দুচোখ মেলে বড় পর্দার সেটের সম্মুখে মুখিয়ে থাকতো। সে সময়ের সিনে জগতের সোনালী দিনগুলো আজ সবই ফিকে।
এ প্রসঙ্গে কথা হলে বছর সত্তরের নন্দিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক মস্তফা চৌধুরী প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৮৫ সালে অবকাশ সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছি। পরে ১৯৮৬ সালে নন্দিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে নন্দিতা সিনেমা হল এখন শুধু নিয়ম রক্ষার্থে চলছে। এখন তেমন একটা সিনেমা প্রেমি দর্শকরাও হলে দেখতে আসেনা। কোনো রকমে হয়তো খোলে রাখা হয়েছে নিয়ম রক্ষার্থে। আমি আশা করেছিলাম সিনেমা হল খোলে রাখা হলে কিছু একটা আসবে। কিন্তু তা কিছুই হয়নি। কেননা বর্তমান যুগ হচ্ছে আধুনিক। তাই ঘরে বসেই ডিজিটাল যুগের মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা বিভিন্ন মাধ্যমের উপর নির্ভর করে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উচ্চ শ্রেণির সিনে প্রেমি দর্শকরা হলে ভীড় করছেনা। অন্যদিকে দেশের সিনেমাগুলো রিলিজ ভালোভাবে হচ্ছে না। তাই হলে সিনেমা নেই বললেই চলে।
তিনি বলেন, আগে এই হলগুলো খুবই জনপ্রিয়তা ছিলো। তখন দেশে ১১শ/১২শ’ সিনেমা হল ছিলো। এর মধ্যে সিলেটে ছিলো ৭টি হল। কিন্তু হঠাৎ মহামারি করোনার প্রভাবে প্রায় ৬০ শতাংশ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে দেশে সিনেমা হল সচল আছে প্রায় ১১৭টি। এর মধ্যে সিলেটে ১টি সিনেমা হল খোলা আছে। তাও আরও দুই তিন মাস চলবে, পরে বন্ধ হয়ে যাবে। ঘটনা হচ্ছে যে, কোনো জিনিসের একটা প্রভাবের প্রয়োজন মানুষের চাহিদার জন্য। কিন্তু প্রভাব না থাকলে মানুষ কিভাবে আসবে। সিনে পাড়ায় নতুন কোনো ছবি আসছেনা।
এছাড়া করোনার কারণে সব ছবি স্থগিত। ছবির প্রভাব থাকলেও যারা ব্যবসার লালন-পালনে যে ছবি প্রডিউস করছে তার একটা খরচ পরে প্রডিউসারের উপর। এই খরচ না আসলে ছবিটা রিলিজ হচ্ছে না। এটাও একটা সমস্যা। যদি ছবি আসে, লোক অবশ্যই আসবে। যেহেতু করোনার কারণে ব্যবসার অবস্থা খুবই নাজুক, তাই ছবি রিলিজ হচ্ছে না।
সম্প্রতি সিলেটের বিভিন্ন শিল্পকলা একাডেমিতে ছবি রিলিজ প্রসঙ্গের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বড় বড় সিনেমা হলের চাহিদা অন্যরকম। এখনো নিন্ম শ্রেণির সাধারণ মানুষ আসে সিনেমা হলে। কেননা তাদের তো আর অন্য কোন অপশন নেই তাই। তবে যেকোন শিল্পকলা একাডেমিতে ছবি রিলিজের আগে সিনেমা রিলিজ হয় বড় বড় হলগুলোতে। পরে অন্যান্যতে। বর্তমানে সিলেটের নন্দিতা হলের নয়মাস ধরে মালিক নেই। ওরা সিনেমা হলটি ভাড়া দিতে চাই। সে কারণে আমাকে ভরসা করে হলটির দায়িত্ব দিয়েছে বহু দিনের পুরনো পরিচিত মানুষ বলে। তাই এখানে এসে অবসর সময় কাটিয়ে নেই। এক সময় সিলেটে ৭টি সিনেমা হল থাকলেও নন্দিতা হল কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলো না। সিনে প্রেমি লোকেদের ভীড়ে গম গম করতো। সেকালে নন্দিতাও দর্শক হৃদয়ে জায়গা করেছিলো। সেই সময়ের সোনালী দিনগুলো বেশ ভালোই ছিলো নব্বই দশক পর্যন্ত।
সিনেমা শিল্প টিক থাকুক এটা আমরা সবাই চাই বলে মন্তব্য করলেন প্রতিবেদককে সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিসফাক মিশু। তিনি বলেন, সময়ের সাথে যদি আমাদের সিনেমা হলগুলো আধুনিক না। যেখানে এসি, ভালো বসার ব্যবস্থা আর ভালো সাউন্ড সিস্টেম আছে সেখানে লোকের সমাগম ঘটবে। অথচ আমাদের সিলেটের হলগুলো এই উন্নতি নেই। হলগুলো হচ্ছে না আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ ও এই সমাজকে টার্গেট করে। আমার আপনার পরিবার নিয়ে দেখার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছেনা। যদি সিনেমার মালিক এবং সিনেমা হলের মালিকেরা এগিয়ে এসে পরিবার নিয়ে বসে দেখার মতো পরিবেশ তৈরি করে, তবে অবশ্যই সিনেমার দর্শক আবার সিনেমার হল মুখি হবে। হলে না গিয়ে আমি বুঝতে পারবোনা ভালো সিনেমা না খারাপ সিনেমা।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশের সিনেমাগুলো তৈরি করা হচ্ছে হিন্দি সিনেমা নকল করে। হিন্দির মতো নাচ ও গান দেওয়া হচ্ছে। সিনেমা হবে আমার সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে। আমার নায়কা হবে শাড়ি পড়নে রবিন্দ্রনাথের রচিত চরিত্রের। হতে পারে শরৎ চন্দ্রের রচিত চরিত্রের। এই সব বিষয়ে নির্মাতাদের দৃষ্টি দিতে হবে।