logo
আপডেট : 23 October, 2022 23:10
স্বজনবিহীন ছন্দে তারা আলোর খোঁজে
অমিতা সিনহা

স্বজনবিহীন ছন্দে তারা আলোর খোঁজে

খোলা আকাশের নিচে সবুজ মাঠে ক্রিকেট খেলায় দৌড়ঝাঁপে মগ্ন একঝাঁক কোমলমতি শিশু। কারো হাতে বল তো, কারো হাতে ব্যাট। পাঠ করে ওরা একই বিদ্যাপীঠে। বসবাসও একই বাসস্থানে। তারা আপনঘর ছাড়া। বিভিন্ন পরিবার থেকে আগত তারা এখন একই সংসারের সদস্য। 

স্বজন ছাড়াই এই কোমলমতি পড়ুয়ারা শিক্ষার আলোয় প্রকৃত মানুষ হতে স্বপ্ন বুনে। যে কচি বয়সে পিতা-মাতা, স্বজনদের ছায়া খুবই প্রয়োজন। সেই ক্ষণে ওরা স্বজনবিহীন ছন্দে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ে ওঠে। আশ্রয় হয় এতিমমখানায়। এই এতিমখানার প্রকারভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে। কোনোটির নাম ‘শিশু নিবাস’, কোনোটির নাম ‘ছোটমণি নিবাস’, কোনোটির নাম ‘সরকারি শিশু পরিবার (বালক)’ আবার কোনোটির নাম ‘সরকারি শিশু পরিবার(বালিকা)’। আর এখানে রয়েছে ১৬৫জন এটিম। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু বয়সী। ওরা সবাই সিলেট শহরের বাগবাড়ীর সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এটিমখানায় বসবাস করছে। 

বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক  চাহিদা প্রয়োজন তার শতভাগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। অথচ এই শিশুরা ১৮ বছর পর জানেনা ওদের সর্বশেষ ঠিকানা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ভবিষ্যতে কি হবে? তবুও ওরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকের মতো পেশার স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে। 

দশ বছর বয়সী তোফায়েল আহমদ খুব মন দিয়ে সিলেটের বাগবাড়ীর ‘সরকারি শিশু পরিবার (বালক)’ এ পড়াশোনা করছে। প্রতিবেদককে তোফায়েল বলেন, মা থাকে লামাকাজিতে। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই ছোটমণি নিবাসে ছিলাম। পরে সরকারি শিশু পরিবারে আসি। এখানে থেকেই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছি। পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাই। 

এসময় সবুজ মাঠে দৌড়ঝাঁপ দিয়ে খেলা দেখছিলো নয় বছরের মো. মারুফ ইসলাম। ৩য় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্র মারুফ বলে, সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) থাকি আর পড়াশোনা করি। ১৮ বছর পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা করার সুযোগ আছে। আর ভালো পড়াশোনা করলে ২০ বছর পর্যন্ত পড়াশোনা করাবে বলেছেন শিক্ষককেরা। বড় হয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ার  হবো। স্বজন প্রসঙ্গে সে বলে ওঠে. এখানে বাবা মাঝে মাঝে দেখতে আসে। কিন্তু কখনো নিয়ে যায় না বাসায়। 

একই শ্রেণির পড়ুয়া মো. ইব্রাহিম আলী জানায়, আমার মতো এখানে অনেক ছেলে বন্ধু আছে, ওরা এখানেই থাকে আর পড়াশোনাও করে। আমাদের কাছ থেকে খাবার-দাবার  ও পড়াশোনার জন্য টাকা নেওয়া হয় না। সব কিছু এখান থেকে দেওয়া হয়। এসময় শিশু শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোটমণি নিবাসের ফাহিম আহমদকে (৬)  মাতা-পিতার কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে সে বলে, আমি জানিনা। তখন ২য় শ্রেণির মো. ময়নুল জানায় আমারও মা-বাবা নাই। কিন্তু শুনেছি আমার এক চাচা আছে। পড়াশোনা শেষ করে চাচার সাথে চলে যাবো। এজন্য আমাকে ভালো মতো পড়াশোনা করতে হবে। 

এ বিষয়ে সরকারি শিশু পরিবার (বালক) এর দায়িত্বরত কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বৃষ্টি প্রতিবেদককে বলেন, যারা এই এটিমখানায় অবস্থান করছেন, ওদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগীতায় সরকারিভাবে  মাসিক একটা বরাদ্দ থাকে। ওটা দিয়ে ওদের যাবতীয় খরচ আমরা বহন করছি। একটা পরিবারে ছেলেমেয়ের যে দায়িত্ব বহন করে, সেটা এখানে বহন করা হয়। এছাড়া শারীরিক অসুস্থতা ও পড়াশোনার যে সমস্ত সুবিধা প্রয়োজন তার সবগুলোই দেওয়া হচ্ছে। এটিমখানায় ১৭৫টি  আসনের মধ্যে ১৬৫জন এটিম শিশু অবস্থান করছে। আর এই এটিম শিশুদের শিশু শ্রেণি থেকে পড়াশোনা করানো হয় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। প্রাইভেট পড়াশোনার ব্যবস্থা, বিভিন্ন স্কুলেও পাঠদানের সুবিধা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, যে শিশুরা জেলা প্রশাসনের বা সমাজসেবার মাধ্যমে আছে, তাদের অবস্থান বুঝে প্রথমে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়। যখন ওর বয়স ৬/৭বছর হয়, তখন তাকে শিশু পরিবারে রাখা হয়। এরপর বয়স ভেদে অন্যান্য নিবাসে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮বছর পর্যন্ত পড়াশোনা শেষে ওদেরকে স্বজনরা এসে নিয়ে চলে যায়। আর যাদের কেউ নেই, তাদেরকে গ্রাজুয়েসন পর্যন্ত পড়াশোনা করা হয়। 

সিলেট সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক নিবাস রঞ্চন দাস বলেন, এতিমখানায় যারা অবস্থান করছে, ওরা অধিকাংশেরই পিতা নাই, মা আছে। স্বজন আছে। কারো আবার কেউ নাই। নানা বয়সের এতিমদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে সব ধরনের সাহায্য সহযোগীতা করা হয়। ওদের লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকে ১৮বছর পর্যন্ত। এরপর পরিবারের কাছে চলে যায়। আর যাদের কেউ থাকেনা তাদেরকে গ্রাজুয়েশন শেষ করায়। ওরা যেন সমাজে কিছু একটা করে খেতে পারে, সে ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি আমরা।