গত ২০ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাসের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন। আইসিসির প্রধান আইনজীবী ওইদিনই একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট উপত্যকাটিতে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ তার কাছে রয়েছে। গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে প্রায় ৩৭ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। আইসিসির প্রধান আইনজীবী হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফ ও ইসমাইল হানিয়াকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদারকির জন্য অভিযুক্ত করেছেন। ওইদিন দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। তারা ২৫০ জনকে আটক করে নিয়ে যায়।
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসেছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তারা। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হামাস নেতারাও। মানবাধিকার সংগঠনগুলো আইসিসির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরাইলের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন বিটসেল্ম বলেছে, এ গ্রেফতারি পরোয়ানা ‘ইসরাইলের নৈতিক অধঃপতনের’ প্রতীক। বর্তমানে আইসিসির সদস্য বা রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ ১২৪টি। এর মধ্যে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র নেই। ইসরাইলও এতে স্বাক্ষর করেনি।
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোতেও সফর করতে পারবেন না, কেবল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোতে সফরে গেলে তিনি গ্রেফতারের সম্মুখীন হবেন। ইসরাইল যুগ যুগ ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এবারই প্রথম আইসিসিতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হলো। রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সব দেশ আইসিসিকে সহযোগিতা করতে বাধ্য। কারও বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হলে এসব দেশ সফরে তাকে অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। এর ফলে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও বিদেশ সফরের সুযোগ কমে যাবে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ এবং শিশুদের ইউক্রেন থেকে অবৈধভাবে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০২৩ সালের ৯-১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে অংশ নিতে পারেননি পুতিন। গ্রেফতার এড়াতে ওই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনেও অংশ নেননি পুতিন।
আইসিসি প্রতিষ্ঠার পর কোনো পশ্চিমা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেনি। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিচারের এ হাতিয়ারকে কেবল শত্রু ও দুর্বল রাষ্ট্রের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আইসিসির প্রাক-বিচার চেম্বারের বিচারকদের একটি প্যানেল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে আইসিসির প্রধান আইনজীবীর করা আবেদন পর্যালোচনা করবেন। বিশেষ ব্যতিক্রম না হলে আইসিসি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ক্ষতির কারণ হতে পারে। বর্তমানে আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র ১২৪টি। অভিযুক্তরা আইসিসির কোনো সদস্যরাষ্ট্রে গেলে গ্রেফতার হতে পারেন।
রোম চুক্তির মাধ্যমে ২০০২ সালে আইসিসি গঠিত হয়। এর গঠনতন্ত্রে বলা হয়, প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের নিজ দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারকাজ পরিচালনা করা। আইসিসি শুধু তখনই হস্তক্ষেপ করে, যখন একটি রাষ্ট্র এমন অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্তে অস্বীকৃতি জানায় বা অসমর্থ হয়। এ চুক্তির অনুচ্ছেদ ৪, ১২ ও ২৫ অনুযায়ী, আইসিসি শুধু তার সদস্যরাষ্ট্রে অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী কোনো অপরাধ হলে অপরাধীর বিচার করতে পারে। এ ছাড়া রোম চুক্তির ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ স্পেশাল রেজুলেশন করে আইসিসিকে ক্ষমতা অর্পণ করলে সদস্যরাষ্ট্রের বাইরে হলেও আইসিসি বিচার পরিচালনা করতে পারে।
এটা সত্য, ইসরাইল আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র নয়; কিন্তু অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘটিত সব অপরাধের বিচারের ব্যাপারে আইসিসিকে ২০১৫ সালে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। ফলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও বিচারের এখতিয়ার আইসিসির রয়েছে। আইসিসির আসলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সামর্থ্য নেই। আইসিসির কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তা কর্মী নেই। কাউকে গ্রেফতারে আইসিসিকে সদস্যরাষ্ট্রের সরকারের সহযোগিতার ওপরই নির্ভর করতে হয়।
বস্তুত ২০০২ সালে আইসিসি গঠনের পর এ আদালত গুটিকয়েক বিচার কার্যক্রম শেষ করতে পেরেছে-সবক’টি গরিব ও দুর্বল রাষ্ট্রের অপরাধীদের। শক্তিশালী রাষ্ট্রের কোনো অপরাধীর বিচার আইসিসি শুরুই করতে পারেনি। ইসরাইল যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ চালালেও আইসিসি নীরব ছিল। এবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসিতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদনে নড়েচড়ে বসেছে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। আইসিসির নিজস্ব পুলিশ বাহিনী না থাকলেও আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির একটা আইনি ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে, যার কারণে ইসরাইল ভীত। একই কারণে ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, গ্রেফতারি পরোয়ানার জন্য আবেদন করাটা অবমাননাকর।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং তাদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়তো আরও কিছুদিন প্রয়োজন হবে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদনেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরাইলের সমর্থনে ভাটা পড়েছে। আইসিসি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হবে এমন ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর কর্তৃক ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশও। এখন আইসিসি কী উদ্যোগ নেয়, সেদিকে তাকিয়ে আছে পুরো বিশ্ব।
লেখক: সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক আইনের গবেষক।