নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে আসামের ৪০ লাখ বাংলাভাষী
প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে এক সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য দাবি করে থেকে যে আসামে তাদের কোনও নাগরিক নেই। এসব নাগরিক এখন উদ্বেগের মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করছে। কারণ আজ ৩১ আগস্ট আসামের নাগরিকত্বের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
কীভাবে এই বিতর্কের শুরু? বাংলাদেশ থেকে আসা তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের ইস্যুটি কোনও নতুন ঘটনা নয়। আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। সেটা ছিল ভারত ভাগের চার বছর পর। সে সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিপুলসংখ্যক মুসলমানদের আগমন হিন্দুপ্রধান আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানকার অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে এবং নাগরিকত্বের প্রথম তালিকাটি তৈরি হয়।
এই সমস্যা আবার দেখা দেয় ১৯৭০-এর দশকে যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যায়। তাদের একাংশ আসামে আশ্রয় নেয়।
অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) ১৯৭৯ সালে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালে এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। ওই সহিংসতায় দুই হাজার সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসী প্রাণ হারান। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। আসু এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল এই প্রশ্নে শেষপর্যন্ত ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসে। চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসামের বাসিন্দা কেউ এমনটা প্রমাণ করতে না পারলে তাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে এবং তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু চুক্তিটি কখনই বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এতো বছর পর কেন এতো হৈচৈ? অভিজিৎ শর্মা নামে এক ব্যক্তি ২০০৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছে এক পিটিশন দায়ের করেন এবং এনআরসি তালিকা হালনাগাদ করার আবেদন করেন। ২০১৪ সালে আদালত ওই তালিকা ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে আদেশ দেন।
তবে দুঃসাধ্য এই কাজ- যাতে তিন কোটি ২০ লাখ মানুষের দলিলপত্র যাচাই করার ব্যাপার রয়েছে- তা সম্পন্ন করে সরকার ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। যাচাই বাছাইয়ের পর ওই খসড়ার দ্বিতীয় তালিকাটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই।
কারা আছেন এই তালিকায়? এনআরসিতে যাদের নাম রয়েছে তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে তারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে আসামে এসে হাজির হয়েছেন। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য রাজ্যের সব অধিবাসীকে তাদের জমির দলিল, ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টসহ নানা ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়েছিল।
যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে তাদের বাবা-মা বা তাদের বাবা-মা ওই তারিখের আগে থেকেই আসামের বাসিন্দা। খসড়া তালিকা অনুযায়ী, রাজ্যের মোট তিন কোটি ২৯ লাখ বাসিন্দা তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সমর্থ হন। কিন্তু ৪০ লাখ মানুষ এই তালিকা থেকে বাদ পড়েন। নাগরিকত্বের বৈধতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম কেটে দেয়া হতে পারে। এরপর নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হয় এবং ৩৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য দলিলপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
চলতি বছর ২৬ জুন আসাম সরকার ঘোষণা করে যে, এক লাখ বাসিন্দাকে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এবং তাদের আবার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। এনআরসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে যে তালিকা থেকে বাদ পড়া বহু লোকের কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছে এবং কাছের অফিস বাদ দিয়ে বহু দূরের অফিসগুলোতে গিয়ে তাদের কাগজপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগদ করার প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করছে সুপ্রিম কোর্ট। চূড়ান্ত তালিকাটি আজ ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে।
কেমন প্রতিক্রিয়া ছিল আসামে? নাগরিকত্বের তালিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ভারতজুড়ে বহু হিন্দু আসামের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রশংসা করে বলেছেন, অন্য রাজ্যগুলো সেটা করার ‘সাহস’ পায়নি, আসাম সেটাই করে দেখিয়েছে।
কিন্তু বিরোধী দলগুলো এই প্রক্রিয়ার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে এবং বলেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার বহু পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ও লাখ লাখ মানুষকে রাতারাতি রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত করেছে।
বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, এই তালিকা মানুষের মধ্যে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই তালিকার সবচেয়ে সরব সমালোচকদের একজন। তিনি আশঙ্কা করছেন, এই প্রশ্নে ‘রক্তগঙ্গা’ বয়ে যাবে এবং এই প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটা পরিহাস।
কিন্তু আসামের স্থানীয় কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, তারা ‘মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তুতে’ পরিণত করছেন না। তবে এনআরসির প্রধান প্রতীক হাজেলা বিবিসি উর্দুর কাছে স্বীকার করেছেন যে যারা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন তারা ‘ভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষ’।
স্থানীয়ভাবে আসামের আদি বাসিন্দা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অসমীয়ারা এই প্রক্রিয়াকে জোরালোভাবে সমর্থন করছেন। অসমীয়াদের মধ্যে নানা ধরনের জাতি ও ভাষা গোষ্ঠী এবং উপজাতি রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলোর সবার ভাষা অহমীয়া হলেও তাদের ধর্মীয় পরিচয় বিভিন্ন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বড় অংশ হিন্দু এবং মুসলমান।
স্থানীয় হিন্দুরা বিপুলভাবে এনআরসির সমর্থক। কিন্তু স্থানীয় মুসলমানরা এ নিয়ে কিছুটা নীরব। কারণ তাদের ভয় এ নিয়ে মুখ খুললে তাদেরও বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে।
আর তাদের এই আশঙ্কার মূলে রয়েছে আসামের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার প্রধানের বক্তব্য যেখানে তিনি খোলাখুলিভাবে বলেছেন যে তিনি মুসলমান অভিবাসীদের চেয়ে হিন্দু অভিবাসীদের প্রাধান্য দেবেন।
এনআরসি প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল? নাগরিকত্ব প্রমাণের প্রক্রিয়া থেকে চমকে যাওয়ার মতো ফলাফল দেখতে পাওয়া গেছে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বর্তমান রাজনৈতিক নেতা এমনকি কিছু সরকারি কর্মকর্তাও ওই তালিকায় তাদের নাম খুঁজে পাননি।
সামান্য বানান ভুলের জন্য আবেদনকারীদের দলিলপত্র খারিজ করে দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, কোনও পরিবারের এক সদস্যের নাম তালিকায় রয়েছে। কিন্তু বাদ পড়েছেন অন্য সদস্য।
আসাম নিয়মিতভাবে বন্যার শিকার হয়। এ কারণে বহু পরিবারের সরকারি কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে। দলিলপত্র সংরক্ষণের দুর্বলতা, অশিক্ষা এবং অর্থ না থাকায় মামলা করতে পারেনি বহু পরিবার।
পরিবার ও আন্দোলনকারীরা বলছে, এই অনিশ্চয়তার চাপ নিতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। আসামের প্রতিষ্ঠান সিটিজেন ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস-এর নেতা জামির আলী বলছেন, ‘মানসিক আঘাত ও চাপ’ সইতে না পেরে আসামে ৫১ ব্যক্তির আত্মহত্যার তথ্য তাদের হাতে রয়েছে।
বেশিরভাগ আত্মহত্যা ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের পর। ওই সময় নাগরিক তালিকার প্রথম খসড়াটি প্রকাশিত হয়েছিল।
গণবহিষ্কারের ঘটনা কী আদৌ ঘটবে? এটা এখনও পরিষ্কার না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও যে বহিষ্কার ঘটবে তার সম্ভাবনাও কম। এনআরসি তালিকা থেকে যারা বাদ পড়বেন তাদের নাগরিকত্বও সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে যাবে না। এর বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য তারা ১২০ দিন সময় পাবেন।
তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বহুবার বলেছেন যে, আসামের অবৈধ মুসলমান অভিবাসীদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হবে। তবে বিবিসির সৌতিক বিশ্বাস বলছেন, এসব মানুষকে যে বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। তিনি বলছেন, এর পরিবর্তে ভারত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো ‘নতুন একদল রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক তৈরি করে ফেলতে পারে’ এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। অবৈধ অভিবাসী হস্তান্তরের প্রশ্নে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনও চুক্তি নেই।
ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ শেষাদ্রি চারি বলছেন, বাংলাদেশ বরাবরই এই ইস্যুটিকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবেচনা করে এবং বলে যে এটা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক কোনও বিষয় নয়।’ তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তেরই প্রমাণ পাওয়া যায় যে ভারত পাঠাতে চাইলেও একজন অবৈধ অভিবাসীকেও বাংলাদেশ গ্রহণ করবেন না।
সহিংসতার আশঙ্কা এই তালিকায় যাদের নাম বাদ পড়ছে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আসাম সরকার তালিকার বাইরে থাকা লোকদের ধর্মীয় পরিচয়ের তথ্য প্রকাশ না করলেও ধারণা করা হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই বাংলাভাষী মুসলমান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির একটা সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, ৩১ আগস্টের পর যদি কিছু ঘটে সেটা মোকাবেলার কোনও প্রস্তুতি সরকারের নেই।
পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য রাজ্য সরকার বন্দি শিবির তৈরি করছে, কথিত অবৈধ অভিবাসীদের জন্য শত শত ট্রাইবুনাল গঠন করছে এবং যারা বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হবেন তাদের একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরি করছে।
তবে আসাম ভিত্তিক সাংবাদিক রাজীব ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, এনআরসি পরবর্তী আসামের জন্য ‘দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির’ প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলছেন, সরকার বিদেশিদের ব্যাপারে কোনও পরিকল্পনা নেয়নি, কারণ তারা জানে তাদের বাংলাদেশে ‘ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।’
তাহলে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর কী ঘটবে? বিবিসির সংবাদদাতা নিতিন শ্রীবাস্তব জানাচ্ছে, সব আপিল এবং চ্যালেঞ্জ দূর হওয়ার পর এই তালিকাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা শুরু হতে পারে। আর সেটা শুরু হবে যখন তারা তাদের জমি, ভোটের অধিকার এবং মুক্তির প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে।