ঘ্রাণ, স্পর্শ ও একটি জাদুর হাড়ি || ফাল্গুনী তানিয়া
তিনদিন জ্বরের পর উপবাসী অভূক্ত শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে চার তলায় উঠাল জরিনা। এ ক'দিন কাজে আসা হয়নি। সেদিন কাজ শেষ করে কার্ত্তিক মাসের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘাটপাড়ে পৌঁছে দেখলো এক হাঁটু পানি। নোংরা পানি পার হয়ে বস্তিতে নিজের ঘরে ঢুকে জরিনা তিতিবিরক্ত হয়ে উঠল। টিনের ছাদের ফুঁটো চুইয়ে পানি পড়ে সমস্ত ঘর একাকার। ভেজা কাপড়ে মগ নিয়ে পানি সেঁচে সন্ধ্যায় গা গরম। রাতে এল উথাল-পাতাল জ্বর। গভীর রাতে মনে হলো পেটে দানাপানি পড়েনি।
ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারে তলাতে তলাতে রূপকথার জাদুবুড়ি এলো তার ঘরে। তাকে দিল জাদুর হাড়ি। ‘জাদুর হাড়ি, আমি মায়ের হাতের পিঁয়াজ, আগুনে পোড়া মরিচ আর ঝাঁঝ সরিষার তেল-মাখা বাসি ভাত চাই। সঙ্গে একটু বাসি তরকারি। আর কিচ্ছু না। আহ্ ঘ্রাণ আসছে, মনে হচ্ছে বড় বড় লোকমা নিয়ে একবারে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিই। আহ্! মা, তোমার হাতের মাখা ভাত এমুন মজা।’
ঘুম থেকে উঠে চনমনে খিদেটাকে জাগিয়ে দেয় জ্বর আর অবসাদ। বৃষ্টিতে খড়ি কাঠ ভিজে গেছে, রান্নার উপায় নেই। তিনদিন ধরে দোকান থেকে কিনে আনা বাটার বন আর বিস্কুট চিনি পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে তেতো মুখটাকে বিস্বাদ করে গিলে ফেলেছে জরিনা। কত বার জাদুর বুড়িকে ডেকেছে। জাদুর বুড়ি তার জাদুর হাড়ি নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল এ ক’দিন ম্যাডামদের খিঁচুড়ি, ইলিশ, গরুর মাংস, বেগুন ভাজা, কালিজিরা ভর্তা হাজির করতে। জরিনার ডাকে সে একবারো আসেনি। জরিনা সামান্য কিছু চাইত। মরিচ ডলে লাল করে চ্যাপা শুঁটকি পুড়িয়ে ভর্তা আর মোটা গাম্ভী ধানের ভাত। ভাতগুলো মুখে দিয়ে চিবাতেই থাকতো, চিবাতেই থাকতো। ঝাল লেগে নাক দিয়ে পানি বের হয়ে যেত। ইস্! পোড়া চ্যাপার ঘেরাণ, ... উমম ...পাটায় পিষে ...।
ম্যাডাম এক গাদা থালা-বাসন জমা করে রাখছে, জরিনা প্লেটগুলো আলাদা করতে থাকে। বাতাসে ঘ্রাণ ইলিশ মাছের, বাসি প্লেটে ঘ্রাণটা টক হয়ে গেছে। ঝুম বর্ষায় হাট থেকে ফেরার পথে জরিনার বাজান বিক্রি না-হওয়া, পঁচে যাওয়া ইলিশ নিয়ে ফিরতো। জরিনার মা আঁচলের কাপড়টাকে ছাতার মত মাথায় দিয়ে বাড়ির পিছনের ডোবার পাশের কাগজী লেবুর গাছ থেকে পাতা নিয়ে এসে সরষে মাখিয়ে ইলিশ রান্না করত। সন্ধ্যা হলে ঘুমিয়ে পড়া জরিনা ঢুলুঢুলু চোখে বসে থাকত ইলিশের গন্ধে মাতাল হয়ে।
বড়লোকেরা নাকি মদ খেয়ে নেশা করে, কিন্তু জরিনার ভীষণ নেশা খাবারের ঘ্রাণে। সে নেশায় মুখগ্রন্থি থেকে লালা বের হয়, শরীরে ভালো লাগতে থাকে, পেটে ভাত থাকলে স্বপ্নও দেখতে ইচ্ছে করে, মনে হয় অন্য জগতে হারিয়ে গেছে সে। সেখানে সাদা পরীরা খাবারের থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে-আঙ্গুর, আপেল, বেদানা, শরবত ...আচ্ছা বড় লোকেদের জন্য বেহেস্তে কী থাকবে? ওরাতো দুনিয়াতে সব খেয়ে ফেললো...ও মা বড়লোকরা কী বেহেস্তে গিয়ে পাইন্য ভাত আর আলু ভর্তা খাবে কাঁচামরিচ আর পিঁয়াজ দিয়ে?...কও না মা তোমারে আল্লা বেহেস্তের রাঁধুনী করব তাই না মা ... সবচেয়ে মজার খাবার তুমি ছাড়া কে রানতে পারে মা?
জরিনার হাত থেকে দুধের হাড়ি পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দের মতোই জরিনার মাথা ঘোরে বনবন। দুধ, দুধ, দুধ। দুধ খাইলে শইলে শক্তি হয়। একবার জরিনার এমন জ্বর, শইল কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে জ্বর। নয় মাইল রাস্তা ভ্যানে খ্যাতার উপরে শুইয়ে জরিনাকে সদর হাসপাতালে নেয়া হলো। ডাক্তার বলল ম্যালেরিয়া। ওষুধ লাগবি, পথ্যি লাগবি। দুধ খাতি হবি। ম্যাডামের এত্তো মোটা পোলাপাইন দুইটার দুধের গন্ধে বলে বমি পায়। দুধের কী গন্ধ হয়? দুধের হয় সুবাস, ঘেরাণ।
সেবার জরিনার মা বড় বাড়িতে দুইবেলা কাজ করল জরিনার জন্য একটু দুধ লাগবি বলে। সেই দুধ মা রান্না শেষ হলি ছোট হাড়িত করি চুলার মধ্যি বওয়ায় দিত। দুধ হইত আগুনের নাহান টকটইক্কা। উপরে জমত সর। কী নেশা! মনে হইত এক চুমুকে শেষ কইরা ফেলি। এত্তটুকুন দুধ। আরো চাই, আরো চাই, আর আছেনি? হাড়িটা চামচ দিয়ে চেকে তুলে মা জরিনার মুখে ধরে। ঘিয়ের নাহান ঘেরাণ, তাই না মা? শহুরে দুধে ঘেরাণ নাই। সাদা ফকফইক্কা। সব ঘেরাণ কী গেরামেই থাকে। ম্যাডামের সাজুনি আয়নার সামনে কত্ত রহম ঘেরাণের বাকশো... হেইয়ার মইদ্যে কী ডিম ভাজার ঘেরাণ আছে, চুরি কইরা কাপড়ের তলায় লুকিয়ে আনা ছোট্ট শিশির ঘিয়ে ভাজা ডিম ভাজির ঘেরাণ...ডিমটা মুখের মধ্যে তুলতুলিয়ে চলে যেত আর হাতে লাইগা থাকত ঘিয়ের ঘেরাণ...পরাণের মইদ্যে এত্ত কাঁপনি ওঠে ক্যান ঘেরানের লাইগ্যা...মার শাড়িতে ঘেরাণ থাকে- হলুদ, পিঁয়াজ, রসুন, আনাজ হাতে থাকে কাঁচা মাছের ঘেরান। ঘেরাণে ওম ওম লাগে, মা আরো কাছে আইসা শোও, মা তোমার বুকের মইদ্যে বেহেস্তের ঘেরাণ ... জরিনা ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতে থাকে।
মায়ের শরীলে ঘেরাণ ছিল, জরিনার মানুষটার শরীলেও ঘেরাণ ছিল- ধানের ঘেরাণ। ছোট্ট বেলায় যখন বড় বাড়ির ধান আসতো গরুর গাড়িতে করে, জরিনা গাড়ির পিছন পিছন দৌঁড়াত গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়া ধানের লোভে। পাকা ধানের গন্ধে মঁ মঁ করতো মাঠ। সেই সুবাস পেত জরিনা মানুষটার উদোম গায়ে। মানুষটারে ছুঁইলে মনে হইত ধানের গায়ের মতো খসখসা। রাইতি কালে খসখসা মানুষটা খোসা ছাড়ানো ধানের মতো নরম হয়ে উঠত। মনে হইত পাকা সবরী কলা। খোসা ছাড়িয়ে একটু একটু খেতে মন ভরে যেত জারিনার। কিন্তু মানুষটার বড্ড তাড়াহুড়া। জরিনা যখন বুক ভরে ধানের গন্ধ নিয়ে নেশাটা ধরে আসত, মুখ থিইকা সবরি কলাটা টান দিয়া মানুষটা ভিতরে হান্দাইয়া দিত। জরিনা তখন জিওল মাছের মত তড়পাইতে থাকত। পুকুরের পানি সেঁচে প্যাঁকের মইদ্যে থাইক্কা ধইরা আনা জিওল মাছ। একবার শিং ফুটলে বড় বেদনা তবু মাছ ধরার নেশাটা ছাড়ান যায় না। বিয়ার পরথম দিকে, সেই সময়টাতে মানুষটার শরীরে কাপড়ের ভাঁজে রাখা শুকিয়ে যাওয়া বকুল ফুলের ঘেরাণ পেত জরিনা। তারপর সেই শরীরে মেশে অভাব আর ভাতের কষ্টের নোনা ঘেরাণ।
জরিনা শহরে আসে,
জরিনা বাসা-বাড়িত কাম করে,
জরিনা থালা-বাসন ধোয়,
জরিনা কাপড় কাঁচে,
জরিনা ঘর মোছে,
জরিনা বস্তিতে থাকে,
জরিনার স্বামী দূরে রাজমিস্ত্রির কাজ করে,
জরিনার স্বামী সাত দিনে দশ দিনে একবার আসে,
জরিনার মা নাই, বাপ নাই, স্বামী দূর দেশে, জরিনার চারপাশে খাবারের ঘেরাণ ভেসে আসে, জরিনার জাদুর হাড়ি চায়। অতঃপর জরিনা জাদুর হাড়ি চায়, জরিনা হাড়ি চায়, হাড়ি বলে খাবার নাই, খাবার কি বাণের জলে ভাসে? মাস শেষে জরিনার হাতে অল্প টাকা আসে, জরিনার জাদুর হাড়ি চায়। চুড়ি ফিতা চায়না জরি, চায় না রঙিন শাড়ি, জরিনা চায় যে শুধু একটা জাদুর হাড়ি। সেই হাড়িতে মায়ের ঘ্রাণ, স্বামীর সোহাগ আদর, ভাতের হাড়ির ভিতর জরিনার বেহেস্তের খবর ... জরিনার সাধ কেবল একটা জাদুর হাড়ি...।
লেখক পরিচিতি:
ফাল্গুনী তানিয়া
খন্ডকালীন শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
পিএইচ.ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ফাল্গুনী তানিয়া মূলত একজন গবেষক। ১৯৮২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যশোরের সারসা থানায় তিনি জন্মগ্রহন করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৮ সাল থেকে তিনি শিক্ষকতা পেশায় আছেন।
মাল্যবান ও রাত ভ’রে বৃষ্টি : প্রধান নারী চরিত্রের নারীবাদী আলোচনা, হিমু এবং আমরা তার প্রকাশিত গ্রন্থ। গ্রন্থ দুটি মূলত তার সুদীর্ঘ গবেষণার ফল। ‘বাংলাদেশের নারী লেখকদের উপন্যাস : নারী চরিত্রের স্বরূপ’ নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে পিএইচ.ডি করছেন লেখক।