লুকোচুরি ।। পারভেজ রানা
নিউমার্কেট থেকে খুলনা মেডিকেল কতটুকুই বা দুরুত্ব ? রিকশাতে ভাড়া ৬ টাকা, হেটে গেলে ২০ মিনিট। ৫টা ২৫ মিনিটে কুয়েটের বাসটা নিউমার্কেট স্ট্যাণ্ডে থামল। শাহীন নেমে পড়ল। সাথে রাহুলও। তিন মাস পরে শাহীন টুনটুনিকে দেখতে যাচ্ছে। পকেট গড়ের মাঠ। হুট করে মাথায় ভূত চাপলো রাণীকে দেখতে হবে। রাণীতো রাণী নয়, শাহীনের মনের রাণী। অকৃত্রিম বন্ধুত্ব দু’জনের। তুই-তুকারি সম্পর্ক। শাহীনের জন্য তার দরদ অপরিমেয়। শাহীনের যখন তাকে দেখতে ইচ্ছে করে সে চলে যায় তার কাছে। রাণী এখন কর্ম জীবনে প্রায় প্রবশ করেছে। ইন্টারনি করার পাশাপাশি স্থানীয় একটা ক্লিনিকে পার্টটাইম চাকরি করছে। ক’দিন আগে শাহীন ক্লিনিকে গিয়েছিল তাকে দেখতে। রাণীকে না পেয়ে শাহীন ছুটে চলল মেডিকেলের মহিলা হোস্টেলের দিকে। রাত এগারোটার দিকে তাকে কল দিলো। প্রায় মধ্যরাতে কলের উপদ্রবে রাণী উপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে’?
শাহীন বলল, আমি।
এত রাতে এসেছিস ক্যান?
আমার দেখতে ইচ্ছা হয়েছে, আমি এসেছি। ইচ্ছা হলে নিচে আসবি, না হলে আসবি না।
শাহীনের এই মধ্যরাতের পাগলামীও রাণী সহজভাবে নিয়েছে। এর মধ্যে কতটুকু প্রেম ছিল, আর কতটুকু বন্ধুত্বের অধিকার ছিল রাণী হয় তো তা বুঝতে পারেনি। বুঝলেও তা শাহীনকে বুঝতে দেয়নি। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে শাহীন কনফিউজড। শাহীন তার জীবনে কোন কিছুতেই সিরিয়াস নয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ছাত্রনীতি কোন কিছুকেই সে সিরিয়াসলি নেয়নি। অনর্থক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে ছাত্রজীবন। সেদিকে যেন তার কোন খেয়ালই নেই। কুইন তাকে অনেকবার বলেছে, বাজে অভ্যাসগুলো ছেড়ে দে। শাহীন সে প্রত্যয় নেয়। কিন্তু ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। জীবনে আর কোন কিছুকে সিরিয়াসলি না নিলেও রাণীকে সে সিরিয়াসলি নিতে চায়। বন্ধুত্বের সূত্রে যে ভালোলাগা, বন্ধন। তা যে এরকম করে শাহীনের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠবে তা কি শাহীন জানত? কিন্তু এই পাগলি মেয়েটাকে কে সে কথা বোঝাবে? শাহীন তো পারবে না, রাণী যদি রাগ করে বসে? বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকেও যদি অপারেশন করে আগের মত নরমাল করে ফেলে। শাহীনের নষ্ট জীবনে যতটুকু ভালোবাসার স্পর্শ বুলিয়েছে, সে শুধু রাণীই। শাহীন মর্মে মর্মে বোঝে তার নষ্ট জীবনকে গোছানোর জন্য রাণীর মত মেয়ে প্রয়োজন। জীবনে আর কাউকে কল্পনা করা তার জন্য অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। অনেক সাহস করে শাহীন একদিন তার কুইনকে একগুচ্ছ গোলাপ দিয়েছিল। রাণী কি বোঝে শাহীন কেন তাকে গোলাপ দিয়েছিল? একটা মেয়েকে কীভাবে বোঝাতে হয়, তাকে ভালোবাসি, শাহীন তা জানে না। আজও সে ছুটে চলেছে রাণীকে দেখার জন্য। মনটা যে কেন এমন হয়? মন মানে না। মন মানে না। শুধু এক নজর দেখার জন্য। ২০ মিনিটের রাস্তা যেন ১০ মিনিটেই শেষ হয়ে গেল। হলের খালা জানালেন, রাণী আপা রুমে নাই। এক মামা এসে তাকে নিয়ে গেছে। কোন সে মামা? কোথায় গেল সে? মেডিকেলের গেটে ফোনের দোকান। রাণীকে একটা কল করতে হবে।
দোস্ত পাঁচটা টাকা দে। ফোন করব।
ঠিক আছে এক মিনিটের মধ্যে শেষ করবি।
‘এই রাণী তুই কোথায়? সিনেমা হলে? কোন সিনেমা হল? শঙ্খ? শঙ্খর কোথায়? ডিসিতে? আমি আসব? আচ্ছা আসছি।’
পরের এক ঘন্টা কেটে গেল হাওয়ায় উড়ে উড়ে। মেডিকেল থেকে শঙ্খ সিনেমা হল। ৭ কিলোমিটা রাস্তা তারা পাড়ি দিলো এক ঘন্টায়। সম্ভব হলো। সিনেমা হলের গেট থেকে অনুমতিও মিলল। গেট খোলা হলো শুধু শাহীন আর রাহুলের জন্য।
রাহুল, তুই ভেতরে গিয়ে দেখে আয়।
রাহুল রাজী হলো। ব্যাপারটা তার কাছে এডভেঞ্চারাস মনে হচ্ছে। তারপর রাহুলের হাক ডাক। রাণী তুমি কোথায়? রাণী তুমি কোথায়? এখানে রাণী আছে?
অবশেষে উত্তর দিলো একটি মেয়ে, ‘আমি’।
শাহীন তোমার জন্য নিচে অপেক্ষা করছে, চলো।
রাণী নিচে নেমে এলো। রাণীকে এক নজর দেখেই শাহীনের দেখার তৃষ্ণা মিটে গেল।
রাণী জিজ্ঞেস করল, সুস্থ আছিস তো?
হ্যাঁ। পুরোপুরি।
তা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে।
রাণী তার বন্ধুদের মাঝে এ ধরণের একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য বিব্রত হচ্ছিল।
তুই এভাবে চলে এলি!?
তুই তো আমাকে আসতে বলেছিস।
তাই বলে এভাবে চলে আসবি?
শাহীন টাকা চাইল। সেদিনের পথ খরচা। পকেটে টাকা নেই কানাকড়িও। রাণী তাকে টাকা দিতে পারেনি। পার্স রুমে ফেলে এসেছে। শাহীন তার কাছে আসলে প্রায়ই টাকা নেয়। রাণীও কিছু মনে করে না। কিন্তু আজ সে দিতে পারল না। সাড়ে সাতটা অনেক আগেই বেজে গেছে। কুয়েটের বাস মিস হয়েছে। রাহুলের পকেটেও যথেষ্ট টাকা নেই ক্যাম্পাসে ফিরে যাবার। কায়দা করে সোহাগের একটা বাসে করে তারা ক্যাম্পাসে ফিরল বিনা টাকায়। রাহুলের এক সাংবাদিক বন্ধূ সুমনের সাথেও শাহীন পরিচিত হলো। সুমন প্রতিদিন বিনা টিকেটে বাস ভ্রমণ করে রাতের বেলা, ফেরার পথে।
১১ এপ্রিল পরীক্ষা শেষ। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ। রাণীকে এবার সে একটা শাড়ি উপহার দেবে। ওদিকে ইতালি থেকে এক পরী এসেছে, সে শাহীনকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। বাসার দিক থেকে সবাই তার ব্যাপারে সিরিয়াস। এবারে রাণীর সাথে একটা ফাইনাল করেই ফেলবে সে। পরীক্ষা শেষে শাহীন নিউমার্কেটে চলে যায়, অনেক্ষণ ধরে ডজনখানিক শাড়ি দেখেও সে মত বদল করে। থ্রি-পিস কেনে। দোদুল্যমান মন নিয়ে মেডিকেলের দরজায় পৌঁছায়। আজ আর কল দিলে দেরী হয় না। রাণী খুব শিঘ্রি চলে আসে। রাণীকে দেখে শাহীন ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে।
কেমন আছিস ছাড়া কিছুই বলে না।
হাতের প্যাকেটটা দেখে কুইন বলে, কার জন্য? আমার জন্য? দেখি কী এনেছিস?
কুইন প্যাকেট খুলে দেখে। শাড়ি না পেয়ে অবাক হয়।
আমি তো ভেবেছিলাম তুই আমার জন্য শাড়ি নিয়ে আসবি। আমি নিজে দেখেছি তুই শাড়ির দোকানে ঢুকেছিস। ভেবেছিলাম তোর আনা শাড়ি পরে পহেলা বৈশাখে তোর সাথে ঘুরব।
রাণী, শাড়ি দেওয়ার মানে বুঝিস?
রাণী শাহীনের কথায় হেসে ফেলে। আরে বোকা আমি তো তোর কাছ থেকে তাই চাই। শাহীনের মনটা আর্দ্র হয়ে যায়। সে বলে, এতদিন বলিসনি ক্যানো?
রাণী একটা মুখ ভেংচি দেয়। সব দোষ যেন শাহীনের।
কই তুইও তো বলিসনি।
তারপরের সময়গুলি কেটে যায় সোনালী ডানায় ভর করে গল্পের রাজা-রাণীর মত। রাণী আগের মতই শাহীনের টুনটুনি আছে। শাহীনের নতুন নাম হয়েছে টোনা। তাদের সংসার টোনাটুনির সংসার।