অবশেষে ।। সাবিরা বেগম ডলি
হেমন্ত ঋতু। নীল আকাশে ভাসন্ত সাদা সাদা মেঘ দেখে মনে হয় সত্যি সত্যিই নীল সাগরে ভেলা ভাসছে। এ দৃশ্য দেখে যে কারো মনেই আনন্দে ভরে উঠবে। আর আজ মেঘলার মন তো এমনিতেই ভালো। এইতো কিছুক্ষণ পরেই বাড়ি ভরপুর হবে। কতদিন পরে আজ তার জন্মদিন পালন করা হবে।
বড় বোন নদীর বিয়ের পর আর কোনদিন ছোট-খাটো কোন অনুষ্ঠান করা হয়নি বাড়িতে। তাই সবাইকে চমকে দিবে বলেই এই দিনেই আসতে বলেছে, কিন্তু জন্মদিনের কথা কাউকে বলেনি সে। তাছাড়া আপু, ভাইয়া তো জানেই তার জন্মদিন কবে, জানেনা শুধু অরণ্য।
বান্ধবীরা ঘর-দোর সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে নিজেদের সাজাতে। মা আর সবাইকে নিয়ে রান্নার কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন।
ঘড়ির কাঁটা যেন ঘুরতেই চায়না আজ মেঘলার কাছে। তার এত আয়োজন আর অস্থিরতা দেখে মা রাগ করে বলেন, তোর এই আয়োজন যেন শেষে ভেস্তে না যায়। বুড়ো বয়সে জন্মদিনের শখ চিরতরে মিটে যাবে।
মা তুমি এই অলুক্ষণে কথাগুলো বলো না তো, তুমিই বুড়ো হতে পারলে না এখনো আর আমাকে বলছো বুড়ো,মুখ ঝামটা দিয়ে বললো মেঘলা।
মেঘলা অরণ্যের কথা ভাবে। আজ কদিন হলো তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন চাকুরী ব্যস্ততার মধ্যে কাটাচ্ছে সে। কিন্তু তাই বলে একবারের জন্য আসতে পারে না সে। চাকুরীর ব্যস্ততাই তার কাছে এতটা জরুরী? আজ এলে তার সাথে কথাই বলবে না । এতো ভালবাসি তবু তার কাছে যেন কিছুই মনে হয় না। কি করে প্রমাণ করবো তার বিরহে এক পাহাড় সমান কষ্ট ধারন করি এই হৃদয়ে।
হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘোর কাটে মেঘলার। আপুর ফোন । ওপাশ থেকে আপু বলে দিল, তার ছেলের স্কুলের বন্ধুর বাসায় এক পার্টিতে তাকে যেতেই হবে ।বলল, মেঘলা বোন আমার রাগ করিস না, আমি কাল যাবোই।
মেঘলা কিছুই বলতে পারলো না। কান্না পেল তার।
মা ঘরে ঢুকেই দেখলেন মেঘলা কাঁদছে। জিজ্ঞাসা করতেই মেঘলা বলে দিল, মা আপুরা আজ আসতে পারবে না, বলল কাল আসবে।
মা বললেন,ফোন করে দেখি, কিসের এত ব্যস্ততা তার?
মেঘলা থামিয়ে দিল,না মা ফোন করবে না।
মা চলে গেলে সে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, আপু তুমি আর সেই আপু নেই। আমার জন্মবারটার কথাও তোর মনে নেই। অথচ এই তুই একদিন আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই ফুল হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতিস শুভেচ্ছা জানাতে।আর আজ?
মা আসাতে তার কথায় বাধা পড়লো। তাকে গোসল সারতে বলেন। তিনি বললেন বন্যা না হয় এলো না তো কি হয়েছে? তোর বান্ধবীরা, সমুদ্র, বৌমা ওরা তো আসবে। কেন অরণ্যকে বলিসনি?
মেঘলা চলে যায়। এসময় সমুদ্র অর্থাৎ একমাত্র মেঘলার বড় ভাই এর অফিস থেকে ফোনে জানায় হঠাৎ করেই তাকে হেড অফিসে যেতে হচ্ছে,মেঘলা যেন মন খারাপ না করে। ফোন রিসিভ করেছিল বাড়ির কাজে সাহায্য করে সখিনার মা।
সখিনার মা চেঁচাতে চেঁচাতে বলে দিল খবরটি। বাথরুম থেকে মেঘলা শুনতে পায় সব কথা।
বাথরুম থেকে বের হয়ে মেঘলা মাকে বলে, মা তোমার অনুমান মিথ্যে নয়। তুমি সব আয়োজন বন্ধ রাখো। আমার কেক কাটবার কোন প্রয়োজন নেই। সবাইকে জানিয়ে দাও কাউকে আসতে হবে না। আর অরণ্যকে বলে দাও..... না থাক আমিই বলে দিচ্ছি।
বলেই অরণ্যকে ফোন দিয়ে বলে, অরণ্য...
কিন্তু অরণ্য মেঘলাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে, প্লিজ মেঘলা রাগ করোনা, আমার আসতে দেরী হলেও আমি আসবো। বড় সাহেব এসেছেন, চলে গেলেই আসবো।
কান্না ভরা কন্ঠে মেঘলা বলে, অরণ্য, আজ আমার জন্মদিন, তোমার চমকে দেব বলেই জানাইনি। কিন্তু থাক, তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। বলেই ফোন কেটে দেয়।
ভীষণ কান্না পায় তার। আজ এত খুশির মাঝে এই ছিল তার অদৃষ্টে? অভ্যাস মতই ডাযেরীতে লিপিবদ্ধ করে তার কষ্টগুলি। তারপর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মেঘলা। একসাথে তার মায়ের বেশ কিছু ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিল ।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আর কোন সময় পায়নি কেউ। কষ্টকে মুক্তি দিল সে চিরদিনের মতো।
সব আয়োজন শেষ করে সবাই ঘরে ফিরে। মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বোন নদী। জ্ঞান হারিয়ে পরে আছেন তিনি। এসময় অরণ্য মেঘলার ঘরে বসে তার জন্য আনা গোলাপের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, একি করলে মেঘলা, এতো নিষ্ঠুর তুমি, নিজে পালিয়ে বাঁচলে, একবার ভাবলে না আমার কি হতে পারে?
হঠাৎ মেঘলার বুক শেলফে তার নোটবুকটি দেখে। হাতে তুলে নিয়ে একটা একটা করে উল্টাতে থাকে। গভীর মনোযোগ সহকারে তার লেখা স্মৃতি গুলোতে চোখ বুলায়। অরন্য অবাক হয়ে যায় তার লেখাতে শুধুই তার কথা লেখা। এত ভালবাসতো সে আমাকে? একসময় তার সেদিনের লেখাটি চোখে পড়ে। এতে লেখা---
আমার ব্যর্থতার কোন সীমা নেই। মাঝপথে তেল ফুরিয়ে যাওয়া বিমানের মত উদ্ভ্রান্ত আমার ব্যর্থতা।এক কথায় আমার ব্যর্থতার কোন সংজ্ঞাই নেই। এতো যত্নে লালিত স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় এত দ্রুত মরিচা ধরে বুঝিনি।
আজ ৪ ডিসেম্বর, আমার জন্মদিন। অনেক আশা করেছিলাম তোমরা আমার সুপ্ত আনন্দটা জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু য়খন জানলাম কেউ ব্যস্ততার কারনে আসতে পারবে না, তখন মনে হলো এতো আয়োজন নষ্ট হয়ে যাবে? অবশেষে এলে তো সবাই,শুধুই এক বুক কষ্ট আর এক নদী অশ্রু বিসর্জন দিতে হলো আমাকে। তোমরা সবাই ভালো থেকো।
পুনশ্চঃ অরণ্য তোমাকে সত্যিই খুব ভালবাসি এটুকু বিশ্বাস রেখো।
--মেঘলা
অরণ্য ডায়েরীটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দেই চলে গেল। ডায়েরীতে লেখা কষ্টগুলো থেকে সবাই দূরে থাকুক। মেঘলার সব কষ্ট শুধু তারই প্রাপ্য।