শিরোনাম
আগে চারজন দাঁড়াত, এখন একটা মারলে ৪০ জন দাঁড়াবে: ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে বন্দুক হামলায় নিহত ৩ গিনিতে ফুটবল ম্যাচে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় ১০০ নিহত রাশিয়ার রাসায়নিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান বোমা হামলায় নিহত ভারতে মসজিদে ‘সমীক্ষা’ চালানো ঘিরে সংঘর্ষ, নিহত ৩ সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ভূমিকম্পে ভানুয়াতুতে নিহত বেড়ে ১৪ নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 20 April, 2019 02:05
গল্প

কালো কঙ্কাল | সাইফুর রহমান

কালো কঙ্কাল | সাইফুর রহমান

তালেব মিয়াকে দেখলে যে কোনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরই চমকে ওঠার কথা। এ তো মানুষ নয়, যেন জীবন্ত এক কঙ্কাল।

পার্থক্য শুধু বোধকরি এতটুকুই যেখানে মানুষ সাদা কঙ্কাল দেখে অভ্যস্ত সেখানে হয়তো তারা দেখে জাজ্বল্যমান কালো এক কঙ্কাল মুখ বুজে কাজ করছে কামারশালায়। লিকলিকে, দির্ঘাঙ্গী ও কুচকুচে কালো তালেবের হাত-পা’গুলো এতটাই শীর্ণ যে, শরীরের হাড়গুলো যেন চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসার জন্য সদা উন্মুখ। হাড় চর্মসার মানুষটি যখন উবু হয়ে বসে হাপরটা টানতে থাকে তখন খানিকটা দূর থেকে সত্যি বোঝা যায় না কোনটা হাপর আর কোনটা তার পেট।

জীর্ণ ও কৃষ্ণাভ লুঙ্গিটা হাঁটু ডিঙ্গিয়ে চলে যায় একেবারে ঊরু পর্যন্ত। তোবড়ানো চোয়ালের মাঝখানে বগ পক্ষির চঞ্চুর মতো নাক। ভ্রু-যুগল সূক্ষ্ম ও দূরপ্রসারিত। হাড় জিরজিরে পাঁজর। সব হাড়ই স্পষ্ট গোনা যায় নির্দ্বিধায়। মাথায় সাদা-পাকা চুলগুলো কদম ফুলের মতো ছোট করে ছাঁটা। হাপর থেকে আগুনের উত্তাপের কারণেই হয়তো ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ নগ্ন।

ঘামে ভিজে তালেব মিয়া একেবারে জবুথবু। কামারশালাটিতে তার সঙ্গে আরেকটি ছেলে কাজ করে। হাতুড়ি চালায়, লোহা পেটায়। বয়স আন্দাজ পনেরো ষোলো হবে। নাম, টুকানু। তালেব মিয়ার বাড়ি থেকে দু’তিন ঘর পরই এক ঘুটে কুড়ানি থাকত এক সময়। তার কোনো পোশাকি নাম ছিল কিনা সঠিক করে জানা যায় না। তবে গ্রামে সে মাজু নামেই পরিচিত ছিল। বছর পাঁচেক আগে মাজুর তিরোধান হয়েছে।

সে নাকি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এই টুকানুকে। এ কারণে গ্রামের সবাই ওকে টুকানু বলে ডাকে। তালেব মিয়ার অবশ্য বিশ্বাস হয় না এ কথা। তার ধারণা টুকানু মাজুর-ই অবৈধ সন্তান। বাড়িখাল গ্রাম থেকে এক সময় হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় মাজু। তারপর বছর তিনেক পর ফিরে আসে দু’বছরের একটি সন্তান সমেত। নিজের মানসম্মান ও লজ্জা ঢাকতেই বোধহয় মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল মাজু। যা হোক, সে সবই তালেবের অনুমান মাত্র। নিশ্চিত করে তো আর বলা যায় না সব কিছু।

তালেব টুকানুকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন, বেলা হয়া যাচ্ছে মেলা তবুও লতু আসতিছে না ক্যান। খিদেয় নাড়িভুঁড়ি সব হজম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। টুকানু বলল, আমিও তাই ভাবতিছি কাকা। দুপুরের খাবার নিয়ে লতু আপার তো এতক্ষণে চইলে আসা উচিত ছিল।

টুকানু ডেরা থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে। নাহ লতুর চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। চম্পাহাটি বাজারের ওপর দিয়ে যে পাকা সড়কটি চলে গেছে পশ্চিমে। বাজার সংলগ্ন সেই পাকা সড়ক থেকে আরকেটি কাঁচা রাস্তা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে দক্ষিণে- বাড়িখাল গ্রামে। কাঁচা রাস্তার শুরুতেই দেখা মেলে তালেব মিয়ার কামারশালা।

বেলা আড়াইটা নাগাদ লতিফা এসে পৌঁছায় দুপুরের খাবার নিয়ে। এক হাতে লাল রঙের গামছা দিয়ে বাঁধা খাবারের বোচকা। অন্য হাতে দুটো বই। লতিফাকে দেখেই তবারক মিয়া কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তোর কি কোন জ্ঞান কাণ্ড নেই রে লতু। এত দেরি হলি ক্যান। আমরা তো খিদেয় মরে যাচ্ছি।

লতিফা লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলল, একটু লাইব্রেরিতে গেছিলেম আব্বা। দুটো বই তুলে আনলাম। ভ্রু দুটো কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তালেব মিয়া বলল, তুই এই গল্পের বইটই পড়ার অভ্যেস যে কনথেন পালি বুঝলেম না। শরীলের রক্ত পানি করে তোক অনার্সে ভর্তি করলেম। কাজের পড়াডা ভালো করে পড়বি, তা না শুধু গল্প উপন্যাস পড়ায় মন। এসব গল্পটল্প পইড়ে আমারে মতো গরিব মানুষের কী কাম আমি বুঝবের পারিনে। রেজাল্ট খারাপ হলি আমি তোর লেহাপড়া বন্ধ কইরে দেব এই আমি কয়া রাইকলেম। লতিফা মুখে কিছু বলল না। চুপচাপ শুনে যায় বাবার কথা।

লতিফা দ্রুত হাত চালাতে লাগল। বোচকার গিঁট খুলতে খুলতে বলল, তোমরা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়ে নাও। আমি প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছি। আজ কি পাঠায়ছে তোর মা, তবারক মিয়ার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি লতিফার দিকে। আলু বেগুন দিয়ে মৌরালামাছ চড়চড়ি আর সজনে ডাল। ও হ্যাঁ মিষ্টি কুমড়া ভর্তাও আছে।

ভাত বেড়ে লতু থালা তুলে দেয় তালেব ও টুকানুর হাতে। ডালের বাটিটা নাকের কাছে এনে ঈষৎ শুঁকে তারপর কাত করে খানিকটা ডাল ঢেলে নেয় ভাতের ওপর। এটা তালেব মিয়ার চিরকালের অভ্যাস। স্ত্রী জোবেদা খাতুনের ওপর তার বিশ্বাস নেই।

প্রায় দুপুরেই দেখা যায় বাসি ডাল পাঠিয়ে দেন জোবেদা খাতুন। বাসি খাবার আবার একদম মুখে রুচে না তালেবের। কঙ্কালসার আঙুলগুলো দিয়ে দ্রুত ভাত ভেঙে খাওয়া শুরু করে তালেব। লতু তাকিয়ে তাকিয়ে বাবার খাওয়া দেখে। সংসারের ঘানি টেনে টেনে খুব দ্রুতই বুড়িয়ে যাচ্ছে বাবা। বুকে কাশফুলের মতো সাদা লোমের ঝাঁক। বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলে একফালি রোদ এসে পড়েছে তালেব মিয়ার শরীরে। বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটাগুলো চিক চিক করছে রৌদ্র উদ্ভাসিত সেই মুখে।

লতু সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আচ্ছা বাবা তুমি অন্য কোনো কাম করলেও তো পার। এত কঠিন কাম কি তোমার শরীরে সহ্য হয়। তোমার বয়স হয়ছে না। আমাদের পাশের বাড়ির সুবাস মণ্ডল পেঁয়াজ ও পাট বাঁধাই কইরে বড়লোক হয়া গেল। লতু এসব কথা কেন বলে তালেবের সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। তালেব এত গতর খাটিয়েও সংসারে কোনো উন্নতি নেই। নিজে একা খেটে সংসারে আর কতটুকুই বা উন্নতি করা যায়।

অতিরিক্ত দু-চারজন কর্মচারী খাটানো গেলে তবেই না কিছু অতিরিক্ত অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। সমাজ সংসারে মানুষের নিত্যদিনের অভ্যাস ও আধুনিক প্রযুক্তির আগ্রাসনে এ শিল্পটিও হয়তো একদিন উঠে যাবে। তালেব মনে মনে ভাবে আগে কত কিছু তৈরি হতো এই কামারশালায়, কোদাল, শাবল, কাস্তে, গাইতি, হাতুড়ি, লাঙলের ফলা, বাটাল, দা, বঁটি, কাঁচি, ছুরি, কোচ, বর্শা থেকে শুরু করে বাসন কোসন পর্যন্ত। এখন হাতেগোনা দু-চারটি জিনিস ছাড়া আর কিছুই তৈরি হয় না কামারশালায়। সামনে যে যুগ আসছে একদিন হয়তো এগুলোরও প্রয়োজন ফুরাবে।

তালেব ভ্রু দুটো কুচকে বলল, রাখ তো তোর ওই সুবাস মণ্ডলের কথা। ব্যাটা একটা পাক্কা ধান্ধাবাজ। গ্রামের সবাই জানে সুবাস দু’নাম্বারি কইরে টাকা রোজগার করে। লতিফার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে তালেব বলল, মারে ইডা আমারে পাঁচ পুরুষির পেশা। চালেইকি চটকরে পেশা ছাড়া যায়। আর ওসব ব্যবসা ট্যাবসা আমাক দ্বারা কোনোদিন হয়ও নাই আর হবিও না। শোন, আমাক দেইখে যদি এই পেশার অমর্যাদা করিস তাহলি সেটা মহাঅন্যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে যে ঐতিহাসিক দলমাদন কামানটা আছে না ওটা তোর পূর্বপুরুষের হাতে গড়া। সে কথা কোনোদিন ভুলে যাইস নে মা।

এহনো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সেটা দেকপির যায়। আমার দাদা ইয়াকুব মিয়া ছিল জমিদার আজিম চৌধুরীর প্রধান অস্ত্রাধক্ষ্য। তার বানানো তলোয়ারগুলো এত নিখুঁত ও ধারালো হতো যে, সে তলোয়ার হাতে নিয়ে কেউ শূন্যে ঘোরালি বাতাস পর্যন্ত আর্তনাদ করে উঠত ব্যথায়। বুঝলি কিছু। তালেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে আমারে পূর্বপুরুষের কেউ আর এখন এ ব্যবসায় নাই। সবাই এহন ঢাকার দিকে ছুটতিছে। গার্মেন্সে কাজ করে, মুজরি খাটে, রিকশা টানে।

কথা মিথ্যে বলেনি তবারক। পেটের তাগিদে অনেক কর্মকারই এখন ঢুকে পড়েছে নানামুখী কাজকর্মে। কামান তলোয়ারের কথা না হয় উহ্যই রইল। দা, বঁটি কুড়াল বানানো বাদ দিয়ে এখন তারা ঢুকে পড়ছে পেরাক, গজাল, তারকাঁটা, নৌকার কাঠ জোড়া দেয়ার শলা, পাতাম এসব তুচ্ছ জিনিসপত্র তৈরির কাজে। কেউ কেউ টিনের পাত কেটে তৈরি করে কুপি, বালতি, কৌটা, ট্রাংক, বাক্সপেট্রা, গুড় জ্বাল দেয়ার তাফাল, রুটি ভাজার তাওয়া। প্রকৃত কর্মকাররা আড়ালে আবডালে টিপ্পনি কেটে সেসব কামারদের ডাকে ‘টিনেকামার’ বলে। টিনেকামাররাও ছাড়ার পাত্র নয়।

তাদের ভাষ্য তোমরা দা, বঁটি, কুড়াল, শাবল বানিয়ে জাতির এমন কী উদ্ধার করছ যে তোমরা হয়ে গেলে কুলিন ব্রাহ্মণ আর আমরা সব শূদ্র। যুক্তি অকাট্ট সন্দেহ নেই। কিন্তু বিষয় এগুলো কামার সম্প্রদায়ের মধ্যে নিত্যদিনের ঝগড়ার বিষয়-আশয় ছাড়া তো অন্য কিছু নয় সেটা তালেব খুব ভালো করেই জানে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফেরে তালেব। জোবেদা খাতুন লতুর মাথায় তেল দিচ্ছিলেন। লতুর মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে তালেব মিয়াকে উদ্দেশ করে জোবেদা বললেন, খাবারের গামলা ও থালাবাসনগুলো ঘরের দাওয়ায় রাইখে আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। লতুর চুল আছড়ানি শ্যাষ হলি আমি আপনাক গুড় মুড়ি দিচ্ছি। মেয়ের পাশে বসলেই এক অজানা কারণে জোবেদা খাতুনের মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।

যদিও লতুর গায়ের রঙটা খোসা ছাড়ানো তেঁতুলের মতো কিন্তু মেয়ে তার দেখতে বেশ আকর্ষণীয়া। দীর্ঘাঙ্গী। ভরাট নিতম্ব ও বুক। সব সময় পরিচ্ছন্ন পরিপাটি চলাফেরা। লতুর শরীর থেকে সব সময় জবাকুসুম তেল আর শিউলী ফুলের সুবাস মেশানো সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়। জোবেদার ইচ্ছা করে লতুর চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে। তা ছাড়া লতুর সুপ্ত বৌদ্ধিক প্রতিভাও গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে থেকে ঢের আলাদা।

বাড়িতে ঢোকার মুখেই বড় এক পুঁইমাচার বাগান। পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে পুঁইপাতার মিশমিশে কালো পুরুষ্টু ফল। পুঁইমাচা পেরোলেই কলপাড়। সবুজ ছ্যাতলা পড়া কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে তালেব লক্ষ করল উঠানের এক পাশে স্বকল্পিত হাপর বানিয়ে দা, কাচি, বঁটি ইত্যাদি তৈরির কামার কামার খেলায় মসগুল হয়ে আছে তার দুই আত্মজ রঞ্জু আর মঞ্জু।

রঞ্জুর বয়স ছয় বছর আর মঞ্জুর চার। তালেব মিয়া খেঁকিয়ে উঠলেন- আমি সকাল সন্ধ্যা গতরপাত করে তোদের লেহাপড়া শেখাচ্ছি কি কামার হওয়ার জন্যি। দাড়া আইজ তোদের কামার খেলা ছুটাচ্ছি। এই বলে তালেব মিয়া ওদের দিকে তেড়ে যেতেই দু’জন দৌড়ে পালায় বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়ের দিকে। জোবেদা খাতুন তালেব মিয়াকে উদ্দেশ করে বলল- ওরা ছোট মানুষ। ওদের কি কোনো বোধবুদ্ধি আছে। বড় হলি ঠিক হয়া যাবি।

দাওয়াও আইসে আপনি একটু বসেন তো, জরুরি কথা আছে। একটি জলচৌকি তুলে নিয়ে দাওয়াও এসে জুত করে বসে তালেব মিয়া। তারপর বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল- এইবার কয়া ফেল ঘটনা কী? জোবেদা খাতুন বলল- পশ্চিম পাড়ার ঘটক বারেক মোল্লা একটা সম্বন্ধ আনছে আমারে লতুর জন্যি। ছেলের নাম আকেলউদ্দিন। শুনলেম ছেলের অবস্থা নাকি খুব ভালো। বাপ-দাদার অনেক জমিজিরাত আছে। বাবা-মায়ের একই ছাওয়াল। তবে বাবা মারা গেছে মেলা আগে। এখন সংসারে শুধু মা আর একখান বুন। বুনখান ইসকুলে পড়ে। বাড়ি চম্পাহাটি। ছেলে নাকি মাস্টারি করে চম্পাহাটি কলেজে।

বিস্ময়াবিভূত কণ্ঠে তালেব বলল, কও কি লতুর মা! এত ভালো ঘরের ছাওয়াল কামারের মিয়াক বিয়ে করবির চায় ক্যান! পাত্র কি দোজবর। বউ-টউ আছে নাকি আরও দু-একখান। জোবেদা বেগম অস্ফুট কণ্ঠে বলল, বউ-টউ নাই তবে ছাওয়ালের একখান সমেস্যা আছে। পাত্রের বাম হাত নাকি অকেজো। তালেব চোখ দুটি কপালে তুলে বলল, আমার মেয়ের জন্যি বারেক মোল্লা নুলা পাত্র ধইরে আনছে। জোবেদা বলল, ঘটক তো আমাক জানায় নাই যে ছাওয়াল নুলা।

তালেব মিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, তালি তুমি জানলে কি কইরে পাত্রের যে এই অবস্থা। জোবেদা বলল, ঘটক যখন কাইল আমাক কলো- বিয়ে যদি দিবের চান তবে দু’দিনের মধ্যেই দেওয়া লাগবি। না হয় তো ছাওয়াল অন্য জায়গায় বিয়ে কইরে ফেলবি।

আমি আর কি করব পাশের বাড়ির মন্তাজকে পাঠালাম চম্পাহাটি। ছাওয়ালের বউ-টউ আছে কিনা সে খবর নেওয়ার জন্যি। কিন্তু মন্তাজ যে কথা বলল তাতে তো আমার মাথায় আকাশ ভাইঙে পড়ল। জোবেদা খাতুন ঈষৎ আবেগ মেশানো কণ্ঠে তালেবকে বলল, মাথা গরম কইরেন না। আমারে পরিবারের দিকে ভালো কইরে চায়া দেহেন। আমারে মতো মানষির জন্যি এই ছাওয়াল তো আকাশের চাঁদ। না হয় ছাওয়ালের একটা হাত পঙ্গু। পাত্রের জমিজিরাত আছে মেলা। ছাওয়াল শিক্ষিত। মাস্টারি করে কলেজে। এর চেয়ে ভালো পাত্র আপনি কনে পাবেন।

লতিফা খাতুন মাথা নিচু করে বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনছিল একমনে। ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। একটিবারের জন্যও কেউ জানতে চাইছে না এই বিয়েতে তার মতামত আছে কিনা আদৌ- কালো মার্বেলের মতো চোখ দুটোতে সস্নেহ অনুযোগ। বিয়েশাদির বিষয়টাতে বরাবরই তার ভয়। কেমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। তার সঙ্গে কেমন আচরণ করবে। বনিবনা হবে কিনা। এ ছাড়া কত কিছু যে মাথায় আসে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে

স্নায়বিক অস্বস্তির শীতল একটি স্রোত শিঁরদ্বাড়া বেয়ে নিচের দিকে নেমে যায় তিরতির করে। জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। ঈষৎ খয়েরি রঙের ঠোঁট দুটো কাঁপে থরথর করে। জোবেদা খাতুন ও তালেব মিয়া কথা বলতে বলতে কখন যে গাঢ় অন্ধকারের চাদরে মুড়ে দিয়েছে এই বিশ্ব চরাচর কেউই খেয়াল করেনি। আকাশ ভর্তি তারা যেন সেই গভীর অন্ধকারের মধ্যে রং মসালের আলোর মতো ধকধক করে জ্বলছে।

লতিফার প্রতি তালেব মিয়ার স্নেহ ভালোবাসার পরিমাণ একটু বেশি বলা যায়। এর কারণ বোধ করি মেয়েটা দেখতে অনেকটা তার মতো। বিশেষ করে লতুর মুখের ডৌলটি হুবহু তার মতো দেখতে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তার প্রাণপ্রিয় এই আত্মজার বিয়ে হবে একজন পঙ্গু মানুষের সঙ্গে। তালেব মিয়া গভীর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি আর কী কব লতুর মা। তোমরা যা ভালো মনে কর।

পরের দিন রাতেই বিয়ে হয়ে গেল লতুর। নিতান্তই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। বরপক্ষের লোকজন এসেছিল জনাবিশ-পঁচিশের মতো। পাত্রপক্ষের ইচ্ছা এখন শুধু কাবিন করে রাখা। অগ্রহায়ণের শেষে নতুন ফসল উঠার পর ধুমধাম করে মেয়েকে তুলে নেবে।

বাড়িতে ব্যান্ডপার্টি ও সানাই না বাজলেও আহার-বিহারের কোনো কমতি করেনি তালেব মিয়া। পোলাও রোস্ট থেকে শুরু করে মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথা। মাছ, রেজালা, দই সবকিছুর-ই এন্তেজাম করেছিলেন তিনি। বরপক্ষের লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে দেশলাইয়ের কাঠি ভেঙে দাঁত খিলান করতে করতে বলছিলেন, তালেব মিয়ার আতিথেয়তার তারিফ না করে পারা যায় না। প্রতিটি ব্যঞ্জনই সুস্বাদু। আহা! অমন সরেস দই কতকাল পরে খেলাম।

সে যাক। আগে থেকেই বরপক্ষ যেহেতু জানিয়ে দিয়েছে মেয়েকে তারা তুলে নিচ্ছে না সেহেতু বর রাত্রিযাপন করবে মেয়ের বাড়িতেই। সে অনুযায়ী লতুর ঘরখানাই সাজিয়ে গুছিয়ে বাসর উপযোগী করে তোলা হল। রঙিন কাগজ কেটে শেকল বানিয়ে সাজানো হল খাটের চার পাশ। বিছানায় ছড়িয়ে দেয়া হল কাঠগোলাপ আর গাঁদাফুলের পাপড়ি।

রাত্রি দ্বিপ্রহরের কিছু পর বর ঢুকলেন বাসরঘরে। নিজেকে ভেতরে ভেতরে একটু গুছিয়ে নেয় আকেল। খুব করে চেষ্টা করে স্বাচ্ছন্দ্য হতে। জবাফুলের মতো টুকটুকে লাল শাড়ির ওপর সোনালি কারুকাজ করা একটি শাড়ি পরে একহাত ঘোমটা টেনে বিছানার ওপর বসে আছে লতু।

দেউরির কাছ থেকে আকেলের মনে হল যেন সাদা জমিনের ওপর সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটি লাল পুতুল। আকেল সন্তর্পণে গিয়ে বসল বিছানায়। তারপর দু’হাত দিয়ে ধীরে ধীরে লতুর ঘোমটাখানা উন্মোচন করতেই প্রেত দেখার মতো চমকে উঠল লতু। যেন রাজ্যের সমস্ত বিস্ময় নিয়ে সে তাকাল আকেলের দিকে। একি! এ কি করে সম্ভব! সে স্বপ্ন দেখছে না তো?

ওদিকে অনভিজ্ঞ খাদ্যাভ্যাসের কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক তালেব মিয়ার পেটে দেখা দিয়েছে গোলমাল। একটু পর পরই টাট্টিখানায় দৌড়াতে হচ্ছে বদনা হাতে। শেষ রাতের দিকে হঠাৎ তালেব মিয়া জোবেদা খাতুনকে উদ্দেশে করে বলল, ও লতুর মা টর্চলাইটখান কনে। আমার পায়খানায় যাওয়া লাগবি। জোবেদা ঈষৎ তন্দ্রতুর কণ্ঠে বলল, ভালো করে চোখ খুইলে দেহেন।

টেবিলের ওপরই আছে টর্চলাইট। তিন সেলের টর্চখানা বোগলে করে ঘটি হাতে তালেব ছোটে ঘরের পেছনে শৌচালয়ের দিকে। ঘরের পেছন দিকটা উশৃঙ্খল কোঁকড়ানো চুলের মতো ঝোপঝাড়ে আকীর্ণ। এসব ঝোপঝাড়ের মধ্যেই বিষাক্ত স্বাপদ সাধারণত ঘাপটি মেরে থাকে কামড়ানোর জন্য। তালেব পা চালায় সন্তর্পণে।

লতুকে উদ্দেশ করে আকিল বলল, কেমন আছ লতিফা। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই আশ্চর্যান্বিত হচ্ছ, তাই না? লতু অবাক বিস্ময়ে বলল, না, মানে... আমি... আমরা তো জানি আপনার একটি হাত পঙ্গু। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ সবল একজন মানুষ। আকেল হো হো করে হেসে উঠল। হাসলে আকেলের মুখ ঝলমল করে ওঠে।

শোন তাহলে বলি। আমি একদিন কি যেন একটা কাজে তোমাদের ওদিকটায় গিয়েছি, ধর কত হবে এই মাস দুয়েক আগের কথা বলছি। তোমায় দেখলাম শরৎচন্দ্রের পথের দাবি বইটি একহাতে বুকে চেপে অন্য হাতে খাবারের বোঁচকা হাতে কামারশালায় ঢুকছ। আমি তো হতবাক। গ্রামের একটি মেয়ে বুকে শরৎচন্দ্রের বই চেপে ঘুরছে। আমার বেশ আনন্দ হল। এ রকম বেশ কয়েকদিন দেখলাম প্রতিবারই কোনো না কোনো বই তোমার হাতে।

সে হোক রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি কিংবা মানিক বাবুর চতুস্কোন। চম্পাহাটি কলেজে আমি বাংলাসাহিত্য পড়াই। এ পর্যন্ত দু-চারজন ছাত্রছাত্রিই পেয়েছি যাদের দেখেছি গল্প কিংবা উপন্যাসের প্রতি অনুরাগ। তোমাকেই প্রথম পেলাম একজন সত্যিকারের বইপ্রেমী হিসেবে। আর মেয়ে হিসেবে যে তুমি বেশ আকর্ষণীয়া এ কথা তো নির্দ্বিধায় বলা যায়। মনে মনে স্থির করে ফেললাম বিয়ে যদি করতে হয় তাহলে তোমাকেই করব। অন্যদিকে মা হন্যে হয়ে আমার জন্য পাত্রী দেখছিলেন।

তার নজর সবসময় বড় ঘরের দিকে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও গেলেন একটি উপযুক্ত পাত্রী। কিন্তু আমার তাকে মনে ধরল না। আমার মন তো পড়ে আছে তোমার কাছে। বিশ্বাস করো রোজ আধঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে দুপুরের দিকে তোমাদের ওদিকটায় যেতাম শুধু তোমাকে একবার দেখব বলে, দূর থেকে দেখেই আবার চলে যেতাম কলেজে।

আমার মতামতকে উপেক্ষা করে মা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন সেই ধনির দুলালির সঙ্গে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম কী করে ভাঙা যায় এই বিয়ে। আমার দু-একজন বন্ধু স্বজনকে দিয়ে পাত্রীর গ্রামে রটিয়ে দিলাম যে আমার একটি হাত পঙ্গু। আমার শারীরিক ত্রুটির কথা শুনে মেয়েপক্ষ অনিবার্য কারণেই পিছিয়ে গেল। আমি তখন মাকে বললাম, দেখ মা আমার রাগ চেপে গেছে।

ওরা যখন এ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে তখন আমি দু-একদিনের মধ্যেই বিয়ে করে ওদের দেখিয়ে দেব পাত্র হিসেবে আমি ফেলনা নই। তারপর আমিই কায়দা করে ঘটক পাঠালাম তোমাদের বাড়িতে। জানতাম তোমার বাবা কর্মকার। তোমাদের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। কিন্তু আমার তো ওসব প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন আমার মনের মতো একজন স্ত্রী। আমি নিজেও একটু আধটু লেখালিখি করি। সব সময় ভেবেছি আমার বউ যে হবে সে আমাকে বুঝবে বিশেষ করে আমার লেখালিখিতে প্রেরণা জোগাবে। সব মিলিয়ে তোমাকেই আমার যথার্থ জীবনসঙ্গী মনে হয়েছে।

আকিলের মুখে সব শুনে লতিফা একেবারে নির্বাক। কে জানতো এত সুখ লেখা ছিল তার কপালে! এতো কল্পনারও অতীত! তারপর দু’জনের নানা আলাপচারিতা ও খুনসুটিতে রাত প্রায় শেষের দিকে। তখনও চারদিকে তমসার পরিব্যাপ্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো নিঃসঙ্গ রাত্রির অন্ধকার ফিকে হয়ে আসবে। ফুটে উঠবে ভোরের টাটকা সতেজ আলো। লতিফা আকেলকে উদ্দেশ করে বলল, এখন মনে হয় আমাদের শুয়ে পড়া উচিত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। ঘরের পেছন দিককার জানালাগুলো হাট করে খোলা। সেগুলো বন্ধ করতে গিয়ে লতু স্পষ্ট দেখতে পেল আবছা অন্ধকারের মধ্যেই মিশে আছে আরেকটি অন্ধকার। ওর কাছে মনে হল জানালার ওপাশে বিশেষ কিছু একটা শুনার জন্য উৎকীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো এক কঙ্কাল। লতু স্পষ্ট দেখতে পেল আবছায়া সেই অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলো শুধু দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আর দ্যুতি ছড়াচ্ছে তার কালো মুখের উজ্জ্বল হাসি।

উপরে