খোঁপায় বেলী ফুলের মালা......
॥ পি.আর. প্ল্যাসিড॥
ফেইসবুকে পরিচয় হয় জেরিনের সাথে।
স্বার্থ একটি স্ট্যাটাস পোস্ট দেবার সাথে সাথে তার স্ট্যাটাসে লাইক দেয় জেরিন। কি মনে করে স্বার্থ লাইক দেওয়া জেরিনের প্রোফাইল দেখার ইচ্ছে করে। প্রোফাইল ঘেটে তেমন কোন কিছুই পায় না সে। তারপরেও প্রোফাইলে দেয়া ছবি দেখে জেরিনকে স্বার্থর খুব ভালো লাগে। প্রথমে সে ধরে নিয়েছিল এটি কোন ফেইক আই.ডি. না হলেও ততটা একটিভ নয় হয়তো। তারপরেও নিজের ভিতর জেরিনের আই.ডি. টি নিয়ে আরো বেশী কোন কিছু জানার আগ্রহকে দমন করতে না পেরে সে তার ইনবক্সে লিখে ”হাই”। এই ”হাই” লেখার সাথে সাথে উত্তর চলে আসে, ”কিছু বলবেন কি আমাকে? লেখা।
স্বার্থ কোন কিছু না বুঝেই এস এম এস-এর উত্তর লিখে পাঠায়, - আপনার ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে হাই লিখেছি। এরপর একটি হাসির রিয়েক্ট পাঠায় জেরিন। কিছু সময় আবার জেরিনের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার পর লিখে, আপনার প্রোফাইল লক করে রেখেছেন কেন? এর চেয়ে ভালো এই সোসাল মিডিয়াতে না থাকা ভালো নয় কি?
আপনার স্ট্যাটাস গুলো আমি অনেকদিন ধরে খুঁজে খুঁজে পড়ছি। বেশ ভালো লাগে তাই লাইক দেয়া। এর মানে এই নয়, আপনি আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। তা কিন্তু ঠিক না।
স্বার্থ এবার লিখেছে, আপনি অযথা চটছেন।
জেরিন এবার কোন উত্তর দেয় না। স্বার্থ মনে করে, হয়তো সে এখন আর অনলাইনে নেই। স্বার্থর যেনো ধৈর্য্য ধরছে না। সে মনে মনে ভাবে, যদি ঝগড়াও করতে হয়, তাও করবে। এতে বোঝা যাবে জেরিনের সাথে তার বন্ধুত্বটা হবে কি-না। কিছু সময় অপেক্ষা করে এরপর লিখে, - এই, আপনার এই আই.ডি. টা কি ফেইক নাকী?
ফেইক লেখাতে জেরিন আর ইত্তর না লিখে সাথে সাথে ইনবক্সে কল দেয়। এমন সময় স্বার্থ রিক্সা থেকে নামছিল। তাই তার কল রিসিভ করে বলল, - আমি একটু পর কল ব্যাক করি। আমি রিক্সা থেকে নামছি। বলে কল কাটতে যায় তখন অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে, - না আপনাকে কল করতে হবে না। আপনি কেন বললেন এটা আমার ফেইক আই.ডি.? আমিওতো মনে করতে পারি আপনার এটি ফেইক আই.ডি., নাকী?
স্বার্থ রিক্সা থেকে না নেমে একটু বাঁকা হয়ে নামার ভঙ্গিতে বসেই কথা বলে। আমার আই.ডি. যে ফেইক তা এমন মনে হলো কেন?
- আপনার এটা কেমন নাম? স্বার্থ কি কারো নাম হয়?
- হয় না হয়তো, তবে আমার বাবা মা আমার এই নামটিই রেখেছিলেন আমার জন্মের পর।
- আপনি কি হিন্দু নাকী?
রিক্সাওয়ালা বলছে, ভাই আগে ভাড়াটা দেন আমার অন্য ক্ষেপ নিতে হবে। তখন রিক্সার কাছেই দুজন ছেলে মেয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখে মনে হয় ওরা দুজন স্টুডেন্ট। কোথাও যাবে হয়তো, রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। হাতে ওদের বই এবং নোট খাতা। কাঁধে সাইড ব্যাগ থাকলেও বই গুলো ব্যাগে ভরেনি হয়তো এমনই কোন চিন্তা ওদের মনে যে, কেউ দেখে যেনো ওদের স্টুডেন্ট মনে করে, তাই।
স্বার্থ কাধের সাথে মোবাইল ফোন চেপে রেখে কথা বলতে বলতে প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। কথা বলার মাঝখানে একসময় প্রশ্ন করে, আপনি কি আমাকে চিনেন?
- না চিনলে কি কেউ কারো পোস্ট দেখে তা ভালো লাগলে লাইক দিতে আপত্তি নাকী? তাছাড়া আমরা ফেইসবুকে আছি পরিচয় হতেও পারে একসময়।
- আপনি আমার নাম নিয়ে ভাবছেন ভালো, তবে এই নামের সাথে আপনি ধর্ম টেনে আনছেন এটা কিন্তু সু চিন্তার লক্ষ্যণ নয়।
- কি করেন আপনি?
- আমি? বলার মত তেমন কিছু না। কেবল ছাত্রত্ব শেষ করে একটা মাল্টি মিডিয়া কোম্পানীতে ট্রেইনি হিসেবে কাজ শুরু করেছি। আর আপনি?
- হাউজ ওয়াইফ। এক সন্তানের মা। স্বামী ছোটখাট একটা ব্যবসা করেন।
- গত কয়েকদিন ধরে দেখছি আপনি আমার সব পোস্ট দেখে তাতে লাইক দেন।
- ভালো লাগে তাই। হ্যাঁলো, কিছু মনে করবেন না। পরে কথা বলি। একটু সমস্যা আছে। বলেই ফোন কেটে দেয় জেরিন। রিক্সা থেকে নেমে কাছেই তার এক বন্ধুর বাসায় যাবে মনে করে আসা। আসার আগে সে কোন ফোন করে আসেনি। কারণ, সে জানে আজ ছুটির দিন, তার বন্ধু বাসা থেকে কোথাও যাবে না। বন্ধুটি একদম ঘরে থাকা ছেলে। বড়লোকদের ছেলেরা আজকাল অনেকটাই নানা কারণে নিজেদের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে হেড়ে যাবার কারণেই বাইরে কোথাও যায় না।
দেশে যেভাবে বড়লোকের সংখ্যা বাড়ছে, এ নিয়ে মানুষ অনেকসময় তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে বাড়তি কথা বলাবলি করে। সবার প্রায় একই প্রশ্ন, তাদের এতো টাকার উৎস আসলে কি? কোথেকে আসে এতো টাকা কেউ জানে না। যে কারণে বড়লোকের ছেলে মেয়েরা এ নিয়ে বন্ধুদের কথা শুনে নিজেদের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে যখন সঠিক কোন সত্য উত্তর পায় না তখনই তাদের কেউ হয়ে যায় স্বেচ্ছায় ঘর বন্দী আবার কেউ হয়ে যায় বাউন্ডেল বা নেশা খোর। তার এই বন্ধুটি অন্যদের মত নেশাখোর না হলেও ঘর থেকে বের হয় না। একদম ঘর কোনা যাকে বলে। সে তার বাবার রাতারাতি ঢাকা শহরে এই ফ্ল্যাটবাড়ি করার বিষয়টি আবিষ্কার করতে গিয়ে জানতে পায় যে, তার বাবার মাসিক যে বেতন পায় তা দিয়ে তাদের এত খরচ সামলানোই সম্ভব হতো না ঢাকা শহরে, ফ্ল্যাটবাড়ি কেনা তো দূরের কথা।
মেইন রাস্তা থেকে হেঁটে তিন মিনিট সময় লাগে তাদের বাসায় যেতে। গিয়ে দাঁড়োয়ানকে বলে, সে উপরে পাঁচ এর বি ব্লকে যাবে। দাঁড়োয়ান জিজ্ঞেস করে, সাইমন সাহেবের বাসায় যাবেন?
স্বার্থ একটু চুপ করে তার বন্ধুর বাবার নাম মনে করার চেষ্টা করে বলে, হ্যাঁ রকিদের বাসায় যাবো। বলে একটা বড় খাতা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এখানে আপনার নাম আর কোথা থেকে এসেছেন লিখে মোবাইল নাম্বারটা দেন।
স্বার্থ লিখে সামনের দিকে তাকাতেই দাঁড়োয়ান স্বার্থকে ডেকে বলে স্যার, এদিক দিয়ে যান। এদিকে লিফট। স্বার্থ লিফটের সামনে গিয়ে উপরের দিকে মার্ক করা বাটন টিপে দাঁড়ায়। লিফট উপরে ছিল। সেটি নেমে আসতে আসতে সে আবার ফেইসবুকের সেই জেরিনের প্রোফাইলে দেওয়া নতুন ছবির দিকে চোখ রাখতেই দেখে নতুন ছবি দিয়েছে। সাথে লক্ড লেখাটিও তুলে দিয়েছে। এখন তার পুরো প্রোপাইল ঘুরে বেড়ানো যাবে। মনে মনে আনন্দ হয় তার। আনন্দ সহ ভাবে, রকিদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতে দিতে জেরিনের প্রোফাইল ঘেটে দেখবে সে।
ছবিটা তার বেশ পছন্দ। নীল শাড়ি গায়ে জড়ানো। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা প্যাঁচানো। দেখতে বেশ লাগছে। তাকিয়ে দেখতে দেখতে লিফট নীচে নেমে আসলে অটো দরজা খুলে যায়। সে ভিতরে ঢুকে ইংরেজিতে ফাইভ লেখা বাটন টিপে একই ভাবে সেই প্রোফাইল ছবির দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে পাঁচ তলায় গিয়ে লিফট থেমে যায়। থামার পর আগের মতই লিফটের দরজা অটো খুলে যায়। লিফট থেকে বের হয়ে স্বার্থ সামনে যেতেই দেখে এতক্ষণ ধরে ফেইসবুকে যার প্রোফাইল ছবি নিয়ে নানা বিষয় ভাবছিল বাস্তবে সে-ই তার সামনে দাঁড়ানো। স্বার্থ তো অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। একবার নিজের গায়ে টিমটি কেটে দেখে সে ঠিক আছে কি না।
তার গায়ে নীল শাড়ি খোঁপায় বেলী ফুলের মালা প্যাঁচানো। দেখে সে বুঝতে পারে এক্ষুনি যে সে ছবিটা তুলে প্রোফাইলে দিয়েছে। হয়তো বাইরে যাবার আগে সে রেডী হয়ে ঘরে বসে ছবিটি তুলেছে। কিন্তু এখানে কেন? তার সাথে ফেইসবুকেই বা এ্যাড হলো কিভাবে। ভাবতে ভাবতে রকিদের বাসার দিকে এগিয়ে যায়।
সামনে থাকা জেরিন তাকে পাশ কাটিয়ে লিফটে উঠে লিফটের দরজা বন্ধ করে দেয়। লিফট শাহ করে চোখের পলকে নীচে নেমে যায়। এরপর স্বার্থ রকিদের বাসার গেইটে কলিং বেল টিপে। রকির মা গেইট খুলে স্বার্থকে দেখে হাসি মাখা মুখে বলেন, বাবা ভিতরে আসো। রকি তো বাসায় নেই। সে আর ভিতরে যায় না। সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে তারাতারি লিফটে নীচে নেমে আসে। নীচে নেমে জেরিনের খোঁজ করে। সে আর সেখানে জেরিনকে পায় না।
হাঁটতে হাঁটতে আবার বড় রাস্তার কাছে গিয়ে সামনে দিয়ে ক্রিং ক্রিং করে ঘন্টা বাজিয়ে দূরে চলে যাওয়া রিক্সাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে জেরিন কি করে তার ফেইসবুক আই.ডি. খুঁজে পেল? তাছাড়া রকিদের বাসায়ই বা সে কেন? দাঁড়িয়ে হিসাব মেলাতে চেষ্টা করে। হিসাব তার আর মিলে না।
-----------------------------
পি.আর. প্ল্যাসিডঃ জাপান প্রবাসী লেখাক-সাংবাদিক
১৯ মে ২০২০ বুধবার