শিরোনাম
অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্র সংস্কার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপে তৎপর ভারতীয় আমেরিকানরা টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা সাকিবের যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্রে রাশিয়ায় হামলা করল ইউক্রেন কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় ভারতীয় সেনা নিহত সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর গাজায় ১০০ ট্রাক ত্রাণ লুট করে নিল মুখোশ পরিহিতরা নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 20 July, 2020 20:16

আমার প্রথম কবিতা "চম্পার উদ্দেশ্যে"

 আমার প্রথম কবিতা

 

 ॥ পি.আর. প্ল্যাসিড ॥ 

জীবনের প্রথম কবে কবিতা লিখেছি সেটা সঠিক মনে করতে পারছিনা। সম্ভবত তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া কালে আমার কবিতা লেখা শুরু। যদিও আমার লেখা সেই কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতা হিসেবে ধরা হয়নি তারপরেও বলছি আমার জীবনে সেটাই ছিল প্রথম কবিতা লেখা। তবে সেই সময়ের কবিতার কোনো কিছুই এখন আর মনে পড়ছে না।

একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে আমাদের গ্রামের স্কুলে প্রভাত ফেরী উদযাপনের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেই পাঠ করেছিলাম সম্ভবত স্বরচিত কবিতার বদলে অন্য কারো লিখে দেওয়া কবিতা (সম্ভবত বড়বোন সেটি সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন)। এরপর তো বাংলা পাঠ্য বইয়ে যে সকল কবিতা ছিল তা মূখস্থ করেছি, তার বাইরে মনে পরছে না ছোট বয়সে আর কোনো কবিতা পড়া বা লেখার কথা। এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে যখন কলেজে ভর্তি হতে ঢাকা আসি তখন থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা পড়তে শুরু করি। আর সেই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত আধুনিক কবিতা পড়তে শুরু করি আমি। তা মনে করছি যে, তাতে কোনো ভুল নেই।

খুব মনে পড়ছে, বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হলে হকারকে ডেকে বলতাম, ভালো যে কয়টি কাগজ বা ম্যাগাজিন রয়েছে সবকটি বাসায় দিয়ে যেতে। বিশেষ সংখ্যা গুলো বাসায় দিয়ে গেলে আমি নাস্তা করার আগেই সবার সেগুলো নিজের রুমে নিয়ে খুঁজে খুঁজে প্রিয় লেখকদের কবিতা গুলো আগে পড়ে শেষ করতাম। আমার এই কবিতা পড়া হলে বাসার অন্যদের পড়ার জন্য পত্রিকা গুলো খাবার টেবিলে নিয়ে রেখেছি। এভাবে আমার আধুনিক কবিতা পড়া হতো নিত্য। কবিতা পড়ে যেটা বেশি ভালো লাগতো সেটির সাথে মিলিয়ে নিজে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। কবিতা লেখার পর সেটা শব্দ করে আবৃত্তি করে পড়তাম। শব্দ করে পড়ার সময় ভুলটা নিজের কানে ধরা পড়তো। কয়েকবার পড়ার পর নিজের কাছে যখন শুনতে ভালো শোনাতো তখন সেটা কবিতা হয়েছে বলে মনে করে আলাদা খাতায় লিখে রাখতাম। তবে থিম নিতাম পত্রিকায় প্রকাশিত কবিদের কবিতা থেকেই। 

১৯৮০ সনের পরের কথা বলছি। আমি এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ঢাকায় কলেজে ভর্তি হই। থাকি বড়ভাইয়ের বাসায়। বাসায় তখন প্রায়ই নতুন-পুরাতন (খ্যাতিমান) অনেক কবি সাহিত্যিকের আসা যাওয়া ছিল। বাসায় সুযোগ পেলে তাদের সাথে কবিতা নিয়ে কথা বলতাম। আমার কবিতার মূল বিষয় হতো তখন মেয়ে, মেয়েদের শরীর এমনকি বুঝে না বুঝে সেক্সচ্যুয়াল কথাও ব্যবহার করেছি বলে প্রথম প্রথম লজ্জায় কাউকে দেখাতে পারিনি আর দেখালেও তাদের কেউ কেউ আমার লেখা কবিতাকে কবিতাই হয়নি বলে ছুড়ে ফেলতেন।

বাসায় সাদা-কালো ২৪" টেলিভিশন কিনে আনার কিছুদিন পর থেকেই আশে পাশের বাসার লোকজন বাসায় আসতে শুরু করে বিটিভি-র প্রচারিত বিশেষ করে সাপ্তাহিক এবং ধারাবাহিক নাটক দেখতে। তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না দেখার মত। বিটিভির অনুষ্ঠান দেখার জন্যই আমরা পাগল ছিলাম। পাশের বাসার অন্যদের সাথে চম্পা নামের বাচ্চা বয়সের এক মেয়ে আমাদের ঘরে আসতে শুরু করে তার বাবা-মার সাথে। প্রায়ই দেখি তাকে আমার খাতার মাঝখানে কোথাও না কোথাও কবিতা আকারে কিছু ছন্দ লিখে রেখে যেতে। কখনও আবার চিঠিও পেতাম বই বা খাতার ভিতর। প্রথম বিষয়টিকে গুরুত্ব দেইনি, আমার থেকে চম্পা বয়সে অনেক ছোট। যখন সরাসরি মুখে একদিন বলতে শুরু করলো চিঠির উত্তর দিতে, তখনই মনে হয় ওর চিঠির উত্তর দিতে শুরু করি। যার মাঝখােন কবিতা বা ছন্দের মত কিছু লেখা হতো।

যে-ই না একবার লিখেছি এরপর থেকে মেয়েটি প্রায় প্রতিদিন আমার ঘরে এসে বই বা খাতার ভিতর চিঠি লিখে রেখে যেতো। ওর বয়স অনেক কম মনে করে পরে একদিন ধমক দিয়ে এসব আর করতে বাধা দিলাম। সেদিনের পর আর কখনও চম্পাকে চিঠি লিখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। তবে ওকে উদ্দেশ্য করেই নিজের খাতার ভিতর কবিতার আকৃতিতে চিঠি লিখতে শুরু করি এবং এসব একটি খাতার মধ্যে লিখে, রেখে দিতাম। মেয়েটি আমার ঘরে এসে অনুমোদন ছাড়াই সেই খাতা খুলে লেখা গুলো পড়তো। খাতাটি আমি কলেজে যাবার সময় অন্য বই-খাতার সাথে নিয়মিত নিয়ে যেতাম। কখনও ঘরে রেখে যেতাম না অন্য কারো হাতে পরতে পারে ভেবে।

আমি এইচ এস সি পাশ করে যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হই তখন নিজের বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েকজনের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওদের সাথে মিশতে গিয়ে আমার নিজের বেশিরভাগ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কলেজ বাউন্ডারির বিভিন্ন জায়গাতে আড্ডা দিতাম। একদিন বাংলা বিভাগের সেমিনার কক্ষে বসে সেই বিভাগের কয়েকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় বাংলার শিক্ষক ওবায়দুল (?) আনন্দ আমার সাথে অন্যান্যদিনের মত বসে আড্ডায় যোগ হলেন (ওনাকে আমি ভাই সম্ভোধন করতাম)। সেখানে সবাই ছিলেন বয়সে আমার চেয়ে বড়। তাদের সামনে আনন্দভাই আমার সেই খাতাটি দেখার আগ্রহ দেখালে প্রথম আমি দেখাতে আপত্তি করি। এর কারণ জানতে চাইলে যখনই বললাম এতে আমার কবিতা লেখা রয়েছে কিছু। তখন অনেকটা জোর করেই খাতাটি তিনি নিয়ে তাতে লেখা কবিতার কিছু পড়লেন।

কবিতা গুলো থেকে কয়েকটি পড়ে তার মধ্য থেকে একটি কবিতা দেখিয়ে সেটা কপি করে দিতে বললেন। আমি তার পছন্দেই একটি কবিতা খাতার অন্য পাতায় লিখে কপি করে দেখালে তিনি কবিতার সেই পাতাটি টেনে ছিড়ে নিলেন। পরে গোফের নীচ দিয়ে সাদা দাঁত বের করে হেসে উনি কাগজটি ভাঁজ করে তার শার্টের বুক পকেটে ভরে নিয়ে যান। দুই সপ্তাহ পর আবার যখন সেই একই কক্ষে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন একটি বড় পত্রিকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, - নেও, দেখো এতে তোমার কবিতা ছাপা হয়েছে। শোনার পর কবিতা দেখার আগেই আনন্দে আমার মন নাচতে শুরু করলো।

পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশের কথা শুনে সেখানে সবাই আমার প্রকাশিত কবিতা দেখানোর জন্য জোর করছিল। আমি তাদের অনুরোধ শুনে লজ্জায় লাল হয়ে উঠছিলাম। এ দেখে আনন্দ ভাই নিজেই সেটা খুলে দেখালেন সবাইকে। তাৎক্ষনিক সেখানে উপস্থিত একজন ডিপার্টমেন্টের বয়কে দিয়ে চা আনিয়ে আমাদের সবাইকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। চা খেতে খেতে বলেছিল, আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতার জন্য সেলিব্রেট করছে। যে এই কথা বলছিল সে এখন আমেরিকা প্রবাসী, নাম রওশন। দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল বৈকি। তবে আমরা খুব আন্তরিক ছিলাম একে অপরের, এতে ভুল নেই। রওশন অবশ্য বড় বোনের পরিচিত, তাই সম্পর্কটা বন্ধুর মত হলে কি হবে ভিতরে বোনের মতই মনে হতো। 

আনন্দ ভাই আমাকে নিয়ে রসিকতা করতে আবার কিছুটা খিলখিল করে হেসে বলছিলেন-আরে তোমরা শোনো, প্ল্যাসিড প্রেমের কবিতা লিখেছে। ও যে প্রেম করে দেখেতো বোঝাই যায় না। তবে ভালো লিখেছে, তাতে সন্দেহ নেই। বলে, সবার সামনে পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন। আমার নিজের কাছে তখন এমন প্রেমের কবিতা শুনে লজ্জা লাগছিল বেশ। তবে সেদিন আমার কবিতা প্রকাশিত হবার  কারণে যেভাবে ওরা আমাকে চা খাইয়ে সেলিব্রেট করছিল তাতে আমার কাছে খুব ভালোই লাগছিল বলা যায়। সেদিনের সব কথা মনে না রাখলে কি হবে, সেদিনের অনুভূতি আমার স্মৃতির পাতায় এখনও রয়েছে স্পষ্ট ভাবে। আনন্দ ভাই আমাকে প্রতি সপ্তাহেই কবিতা দিতে বলে বলেছিলেন, তোমাকে আমি সাংবাদিকতা শিখাবো। পরে যদিও তিনি আমাকে আর সাংবাদিকতা শেখানোর মত কোনো উদ্যোগ নেন নি, তবে আমি সাংবাদিক হয়েছি।

আমার জীবনে পত্রিকার পাতায় প্রথম প্রকাশিত কবিতাটির নাম ছিল ”চম্পার উদ্দেশ্যে”। প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক আবির্ভাব নামের একটি পত্রিকায়, যা প্রকাশিত হতো পুরাতন ঢাকার ইসলামপুর থেকে। এরপর থেকে আমি নিয়মিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন স্মরণিকায় কবিতা লিখে পাঠাতাম, যা ছাপাও হতো সব।
....................................................... 

লেখক: পি.আর. প্ল্যাসিড

 জাপান প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক

উপরে