ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য খেলায় ‘ফাউল’ করলেন যুবরাজ
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব সবসময়ই অন্যরকম। প্রধানত এ অঞ্চলের অফুরান খনিজ তেলই এর পেছনে কাজ করছে। তেলনির্ভর সভ্যতায় তেলের নিয়ন্ত্রণ মানেই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ। কোন দেশ কীভাবে তেলের বাজারে প্রভাব বিস্তার করবে সেটাই বিশ্বরাজনীতির অন্যতম কূটকৌশল।
এ ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য নিজেদের চাহিদা মেটানো এবং একই সঙ্গে ‘শত্রু’ দেশকে বিপাকে ফেলা। মধ্যপ্রাচ্যে ঠিক এই খেলাটাই খেলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তেলের বৃহৎ উৎস মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব বিস্তারে হোয়াইট হাউসে বসে এক ‘নিপুণ’ ছক সাজিয়েছেন ট্রাম্প। ছকটি হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সৌদি আরবের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে এক সামরিক ও রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলা।
সেই জোট দিয়ে আরেক প্রভাবশালী দেশ ইরানকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলা। মাঝ মাঠে হুট করে দৌড়ে এসে ‘ফাউল’ করে বসলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সাংবাদিক জামাল খাসোগির রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে তেল বন্ধু যুবরাজ সালমান ধরা পড়ে যাওয়ায় সেই ছক ভেস্তে যাচ্ছে ট্রাম্পের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খাসোগি হত্যাকাণ্ড বিতর্কে জড়িয়ে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য ছকে জল ঢেলে দিলেন যুবরাজ। খাসোগির হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্ক এভাবেই মূল্যায়ন করে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আলজাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন, কাতার অবরোধ, ইয়েমেনে আগ্রাসনের মতো নানা কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে বিতর্কিত ৩৩ বছর বয়সী যুবরাজ। এর সঙ্গে এবার যোগ হল খাসোগি হত্যাকাণ্ড বিতর্ক। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-প্রমাণ বলছে, খাসোগির হত্যায় আগে থেকেই নিখুঁত ছক কষা হয়। আর এতে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে ট্রাম্প হত্যাকাণ্ডে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। হত্যার সব তথ্য-প্রমাণ হাতে রয়েছে বলে দাবি করছে তুর্কি কর্মকর্তারা। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান বলছেন, কিলিং স্কোয়াডের সদস্যদের এবং এর প্রধান নির্দেশদাতাকেও বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হবে। এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে সেটাই দেখার বিষয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়কার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক শীর্ষ মার্কিন নীতিনির্ধারক মার্টিন ইনডিক। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ট্রাম্পের নীতি সম্পর্কে বলেন, এ অঞ্চলে প্রধানত সৌদি আরব ও ইসরাইলকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ছক কষেছিলেন ট্রাম্প এবং সেটা এগিয়ে নেয়ার কাজ শুরুও করেছিলেন তিনি। কিন্তু পথের মাঝে ওয়াশিংটনের ‘আশার গুঁড়েবালি’ দিলেন বিন সালমান।
শুধু খাসোগির হত্যাকাণ্ড দিয়ে নয়, ইয়েমেন যুদ্ধের মধ্যদিয়েও। প্রায় চার বছর ধরে একটানা ইয়েমেনের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। এই আগ্রাসনে রিয়াদকে সামরিক সহায়তাসহ সব ধরনের সমর্থন দিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। ইনডিক বলেন, ‘ট্রাম্পকে যুবরাজের দরকার।
তার টিকে থাকা এখন নির্ভর করছে ট্রাম্পের সমর্থনের ওপর। ইনডিক মনে করেন, এবারও বেঁচে যাবেন যুবরাজ এবং আগের পথই অনুসরণ করবেন। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আরও শক্তিশালী হবে প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান। আর ক্রমেই সমস্যায় নিমজ্জিত হবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অঞ্চলে মূলত একটা বৃহত্তর প্রকল্প বা ছক নিয়ে এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের প্রভাব খর্ব করতে উপসাগরীয় ছয় মিত্র রাষ্ট্র এবং সেই সঙ্গে মিসর ও ইসরাইল নিয়ে একটি সামরিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনই প্রধান লক্ষ্য। হোয়াইট হাউস ও মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোর কর্মকর্তারা প্রকল্পটিকে ‘আরব ন্যাটো’ বলে অভিহিত করছেন।
ধারণাটি প্রথম আসে সৌদি কর্মকর্তাদের মাথায়। গত বছর ট্রাম্পের সৌদি সফরের সময় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কয়েক হাজার কোটি ডলারের বিশাল অস্ত্রচুক্তি সেই ধারণাই অংশ। তবে খাসোগি হত্যার মধ্যদিয়ে এ প্রকল্প ‘চিরস্থায়ীভাবে দুর্বল’ হয়ে গেল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।