ইয়েমেনে মাটির নিচে পৈশাচিক নির্যাতন
ইয়েমেনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ২০১৫ সাল থেকে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব-আমিরাতি জোট।
গুম, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন- কোনো কিছুই বাদ রাখেনি মধ্যপ্রাচ্যের এই নয়া আগ্রাসী গোষ্ঠী। হুথিদের আটক করে তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাতে মাটির নিচে গড়ে তুলেছে গোপন কারাগার।
সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম এপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে খোঁজ মিলেছে ১৮টি ভয়ংকর বন্দিশিবিরের।
ভূগর্ভস্থ এসব কারাগারে পেটানো, মারধর ও যৌন নিপীড়নের জন্য রয়েছে নির্ধারিত নির্যাতন সূচি। জেলে বন্দিদের ওপর একেকদিন এক এক ধরনের মার চলে। আহত হুথিদের চিকিৎসাসেবা দিতে গেলেও গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন ডাক্তাররা। নিপীড়নের যন্ত্রণায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিদ্রোহীরাও পাল্টা খুলেছে গোপন কারাগার।
দেশটির ভয়াল এ পরিস্থিতিকে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে ‘মানবসৃষ্ট মানবিক সংকট’ বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিত্যক্ত সরকারি বাসভবন, সেনাক্যাম্প, বিমানবন্দর, পুলিশ সদর দফতরগুলোকে কারাগার হিসেবে গড়ে তুলেছে ইয়েমেনের সরকারি বাহিনী, সৌদি ও আরব আমিরাত জোট। তাদের নিয়ন্ত্রণ ও অর্থায়নে পরিচালিত হয় গোপন কারাগারগুলো।
হুথি বিদ্রোহীদের ওপর রুটিনমাফিক চলে নির্যাতন। শনিবার পিটুনি, রোববার যৌন নির্যাতন এবং সোমবার ছুটি। এভাবে পরবর্তী তিন দিন চলে একই নিয়মে। শুক্রবার নির্জন কারাগারে নিক্ষেপ, যেটি হাঁটু গেড়ে বসে থাকার মতো ছোট্ট জায়গা। সানাভিত্তিক অ্যাবডাক্টিস মাদার ইউনিয়নের (এএমইউ) তথ্যানুসারে, কারাগারে নির্যাতনের অতিশয্যায় মারা গেছেন অন্তত ১২৬ বন্দি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে এসব নথি রয়েছে।
কারাবন্দিদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা কয়েকটি ছবি ও চিঠি কারাগার থেকে পাচার হয়েছে। এগুলো এপির হাতে এসেছে। প্লাস্টিকের প্লেটে আঁকানো চিত্রে দেখা গেছে, উলঙ্গ অবস্থায় ঝুলানো এক বন্দিকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হচ্ছে। আরেক বন্দিকে কুকুরের ভঙ্গিমায় মাটিতে বসিয়ে কয়েকজন সেনা লাথি মারছে।
পায়ুপথে ধর্ষণের চিত্র প্রতীকী হিসেবে তুলে ধরেছেন বন্দি ওই চিত্রশিল্পী। এক চিঠিতে তিনি জানান, ‘আমি প্রতিদিনই মৃত্যুর প্রত্যাশা করি। কারণ এ পাশবিকতার চেয়ে মৃত্যুই কম যন্ত্রণার।’ ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বেইর আহমেদ কারাগারে শত শত বন্দির ওপর চলে যৌন নিপীড়ন। বন্দিদের একই লাইনে দাঁড় করিয়ে একে একে সবাইকে উলঙ্গ করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
নির্যাতন থেকে জীবিত ফিরেছেন এমন ২৩ জনের সঙ্গে কথা বলেছে এপি। ইয়েমেনে জোটের চালানো হামলায় আহত হুথিদের চিকিৎসাসেবা দিলে ডাক্তাররাও নির্যাতনের শিকার হন। ২০১৮ সালের জুন মাসে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এমন এক ডাক্তার ফারুক বাকার (২৬)।
রাজধানী সানার একটি হাসপাতালের এ চিকিৎসককে ২০১৬ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ মাসের কারাভোগের বীভৎস অভিজ্ঞতা আলজাজিরাকে জানিয়েছেন তিনি। ফারুক বলেন, ‘প্রায় অক্সিজেনশূন্য ভূগর্ভস্থ কারাগারে ৫০ দিন কোমরে দড়ি বেঁধে আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
এভাবেই মলমূত্র ত্যাগ করেছি। একবারও পরিষ্কার হতে পারিনি। আমার নখগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। তার দিয়ে বেঁধে নিুাঙ্গ টান দেয়া হতো।’ তিনি আরও বলেন, বন্দিশিবিরে মরদেহ, লাশের টুকরো ছড়ানো-ছিটানো থাকতে দেখেছি। আরেক বন্দির বর্ণনা দিতে গিয়ে ফারুক বলেন, ‘এক ব্যক্তিকে পুরুষাঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলানো হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ তিনি প্রস্রাব করতে পারেননি। তাদের এ নির্যাতন দেখে ডাক্তার হিসেবে আমার মনে হতো, আমি মারা গেছি।’
হুথি বাহিনীও গোপন কারাগার গড়ে তুলেছে। বেসামরিকদের নির্যাতন চালিয়ে বড় অর্থের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এএমইউর হিসাবে, গত চার বছরে ১৮ হাজার ব্যক্তিকে কারাগারে ঢুকিয়েছে বিদ্রোহীরা। এর মধ্যে গোপন কারাগারে ১ হাজার ব্যক্তির ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। হুথিদের নির্যাতনে মারা গেছে অন্তত ১১৭ জন।