তুরস্কে ভোট শেষ হলেও হার-জিতের হিসাব চলছে
নানা জল্পনা-কল্পনা আর হিসাব নিকাশ শেষে গত ৩১ মার্চ তুর্কিতে অনুষ্ঠিত হল স্থানীয় নির্বাচন। নির্বাচনের সময়ে সাংবাদিকতার কাজে মরোক্ক এবং গাম্বিয়াতে থাকায় যুগান্তরের পাঠকদের কোনো লেখা দিতে পারিনি।
তবে নির্বাচনের আগে আমার বিশ্লেষণধর্মী লেখাটিতে ক্ষমতাসীন দল একে পার্টির ভরাডুবির একটি আভাষ দিয়েছিলাম। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে রাজধানী আঙ্কারা, তুরস্কের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ নগরী ইস্তানবুল, পর্যটন নগরী আনতালিয়া এবং বন্দর নগরী ইযমির সহ সবকটি গুরুত্বপূর্ণ সিটিকর্পোরেশন ক্ষমতাসীনদের হাতছাড়া হয়েছে।
অন্যভাবে বলতে গেলে প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়িপ এরদোগান বিরোধী জোট সবকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। সরকারি দল কট্টর জাতিয়তবাদিদের সাথে জোট করেও আশানুরুপ ফল পায়নি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এরদোগানের দল এযাবৎকালের সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে।
ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বিরোধীদের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে ছিল। প্রায় সবগুলো প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার একচেটিয়া সাপোর্ট ছিল এরদোগানের একে পার্টি জোটের পক্ষে। রাস্তা ঘাট সয়লাব ছিল তাদের পোস্টার, ফেস্টুন আর ব্যানারে। এতো কিছুর পরেও বিরোধিরা কিভাবে এত বিশাল জয় পায় বিশেষ করে ইস্তানবুল কিভাবে তাদের দখলে যায় এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ভোটার পরদিন প্রকাশিত বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায় ইস্তানবুলের বিরোধী প্রাথী সরকারী দলের প্রাথীর চেয়ে ২৯ হাজার ভোট এগিয়ে আছে।
সেদিন থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশন এখনো পর্যন্ত ইস্তানবুলের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করেনি। ফল নিয়ে সরকারি দলের বিস্তর অভিযোগ। কিছু জায়গায় বাতিল হওয়া ভোট গণনার দাবি তো অন্য এলাকায় গণনা করা ভোট আবার গণনার দাবি কোথাও আবার পুনঃনির্বাচনের দাবি তুলছে সরকারি দল। তাদের সর্বশেষ দাবি হচ্ছে পুরো ইস্তানবুলের ভোট বাতিল করে নতুন নির্বাচন দেওয়া। এই চলছে ইস্তানবুলের নির্বাচন পরবর্তী ভোটের বাজার। নির্বাচন কমিশন এগুলো সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাতিল হওয়া ভোটগুলো নতুন করে গণনার পরে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন আর বিরোধী প্রাথীর মাঝে ভোটার ব্যাবধান ২৯ হাজার থেকে ১৩ হাজারে নেমে এসেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা ইস্তানবুলের এই ফলাফল মেনে নিতে নারাজ তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটে অনেক অনিয়মের অভিযোগ এনে ইস্তানবুল সিটি কর্পোরেশনের ভোট বাতিল করে নতুন ভোট চেয়ে আবেদন করেছে। নির্বাচন কমিশন আগামী সপ্তাহে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।
ইস্তানবুল তুরস্কের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্ষমতাসীনদের কাছে ইস্তানবুল যেমন জীবন বাজি রেখে লড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীরাও তেমনি ইস্তানবুলের দখল পেতে মরিয়া।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১৯৯৪ সালে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচনের মাধ্যমেই তার রাজনৈতিক উত্থানের সূচনা করেন।
তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ক্ষমতাসীনদের। ইস্তানবুল এবং আঙ্কারা গত ২৫ বছরে কখনোই তাদের হাতছাড়া হয়নি। এরদোগানের উত্থানের সাথে উত্থান হয়েছে ইস্তানবুলেরও। একে পার্টির হাতে ইস্তানবুল পায় নতুন গতি, নতুন চেহারা। নতুন নতুন সব প্রকল্প ইস্তানবুলকে গড়ে তোলে ইতিহাস ও আধুনিকতার মিলনকেন্দ্রে। একসময় উসমানীয় সুলতানদের পদচারণায় মুখরিত এই শহর আকৃষ্ট করে লক্ষ লক্ষ পর্যটক।
এরদোগান সব নির্বাচনেই ইস্তানবুলকে আলাদা গুরুত্ব দিতেন। তার ভাষায়, ইস্তানবুলে যে জিতবে তুরস্কের দখল তার কাছেই যাবে। আর ইস্তানবুলে হারলে সারা দেশের ক্ষমতা হাতছাড়া হবে।
এখন এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তার ক্ষমতাসীন পার্টি। তারা কিছুতেই ইস্তানবুলকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। প্রয়োজনে আবার নির্বাচন দিয়ে হলেও ইস্তানবুলের ক্ষমতা চাই তাদের।
রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও ইস্তানবুলের আছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। তুরস্কে স্থানীয়সরকার ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী। গ্রাম, উপজেলা বা সিটি কর্পোরেশনের সীমানার ভিতরের পুরো এলাকার সব উন্নয়নমূলক কাজ করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। এজন্য তাদের আছে নিজস্ব বাজেট ব্যবস্থা, আছে নিজস্ব সংসদ ব্যবস্থা। যেমন ইস্তানবুল সিটি কর্পোরেশনের গত বছরের বাজেট ছিল সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার। যা তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের সমপরিমাণ।
এছাড়াও ইস্তানবুলে আছে হাজার হাজার সংস্থা, এনজিও, সুশীল সমাজ, সামাজিক সহযোগী সংস্থা, সমাজ কল্যান সংস্থা, নারী শিশু যুবাদের সাহায্য ও উন্নয়ন সংস্থা। এগুলোর একটি বড় অংশ সরকারিপন্থী।
ক্ষমতাসীন একে পার্টি এই সকল সংস্থার মাধ্যমেই তৃণমূলে পৌঁছতে পারে। সাধারণ মানুষদের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে পারে খুব সহজেই। আর ইস্তানবুল সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এই সংস্থাগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার অনুদান পায়। ইস্তান্বুল হাতছাড়া হয়ে গেলে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছার এই পথটাও হয়ে যাবে অনেক কঠিন। তবে নির্বাচন কমিশন নতুন করে নির্বাচন না দিয়ে বিরোধী প্রাথীকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজয়ী ঘোষণা করলেও তিনি মেয়র হয়ে নিজের ইচ্ছে মতো সবকিছু চালাতে পারবেন না। যেমনটি বলেছিলাম, ইস্তান্বুল সিটি কর্পোরেশনেরও নিজস্ব কাউন্সিল বা সংসদ আছে। সিটি কর্পোরেশনের বাজেট সহ সব সিদ্ধান্ত এই কাউন্সিলে পাশ করাতে হয়। সরকারবাদীরা এই কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরং তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্তানবুলকে কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি করে দিলো।
তবে একটি বিষয় এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন।বড় সিটি কর্পোরেশনে মেয়র প্রাথীরা হারলেও প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে একে পার্টির অবস্থা এখনো অনেক শক্তিশালী।
প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে এর আগের অর্থাৎ ২০১৪ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একে পার্টি ৪৫ শতাংশ ভোট পায়, এবারেও কিন্তু একই পরিমান ভোট পেয়েছে। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি পেয়েছিল ২৮ শতাংশ এবার ৩০। ক্ষমতাসীন একে পার্টির জাতীয়তাবাদী এমএইচপি দলের সাথে জোটবদ্ধ ভোটের পরিমান ছিল ৫২ শতাংশ এবার প্রায় ৫৩ শতাংশ।