এখন হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা কারা
গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম অভ্যুত্থান বা ‘ইনতিফাদা’ থেকে জন্ম হামাসের। সংগঠনটির দাবি, তারা স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের অধীন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে।
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি ধর্মগুরু শেখ আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি পরে স্বাধীনতার পক্ষে একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন।
ইসলামের মূলনীতিকে সাংগঠনিক কাঠামো হিসেবে ধরে হামাসকে ‘প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক ন্যাশনাল লিবারেশন অ্যান্ড রেজিসট্যান্স মুভমেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
এরপর মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসেবে হামাস মুক্তির জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের সামরিক শাখা, ‘ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেড’ প্রতিষ্ঠা করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গোষ্ঠীটির অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি জনসমক্ষে তেমন আসছেন না। ইসরায়েলের হত্যাচেষ্টা এড়াতে হামাসের অন্যান্য সদস্য নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছে। এদের বেশিরভাগ রয়েছেন কাতারে। তবে অনেকে আবার ইরান, লেবাননে এবং তুরস্কেও আছেন।
সাধারণত গাজায় বসবাসকারী হামাসের সদস্যরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক বেশিরভাগ অভিযানে বেশি চালিয়ে থাকে এবং বাইরের দেশে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনটির রাজনৈতিক শাখার নেতারা। কিন্তু ছিটমহলের সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধে হামাসের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কারা এই গোষ্ঠীটি পরিচালনা করছেন?
নেতাদের মধ্যে ইসমাইল হানিয়া ফিলিস্তিনের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী ও হামাসের তৃতীয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বুধবার ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি বাসভবনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিনসহ তার একজন দেহরক্ষী নিহত হন। ইরানা এবং হামাসের দাবি ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মদতে তাকে হত্যা করেছে। তবে উভয় দেশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
১৯৪৮ সালের নাকবাতে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত শরণার্থীদের একটি পরিবারে জন্ম নেওয়া হানিয়া উত্তর গাজার আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে বেড়ে ওঠেন। ১৯৮৭ সালে যখন হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি গোষ্ঠীর তরুণ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর।
১৯৮৯ সালে ইসরায়েলের হানিয়াকে তিন বছরের জন্য বন্দী করেছিল। পরে দেশটি ১৯৯২ সালে গাজা, পশ্চিম তীর ও অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম থেকে হানিয়াসহ হামাসের ৪১৫ নেতাকর্মীকে দক্ষিণ লেবাননে নির্বাসনে পাঠায়। এরপর তিনি ১৯৯৩ সালে গাজায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯৭ সালে হামাস অফিস পরিচালনার দায়িত্ব পান। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের আইনসভা নির্বাচনে হামাস জয়ী হয় এবং হানিয়া ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে তার প্রধানমন্ত্রীত্ব স্বল্পস্থায়ী ছিল। কারণ হামাস এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর মধ্যে উত্তেজনা একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত করেছিল, যা সরকারকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয়।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ১৪ জুন ২০০৭ তারিখে হানিয়াহকে পদ থেকে বরখাস্ত করেন কিন্তু হানিয়াহ ডিক্রি স্বীকার করতে অস্বীকার করেন এবং গাজায় তার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন। এরপর ২০১৭ সালে গাজায় হামাসের নেতা হিসেবে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের স্থলাভিষিক্ত হন এবং হানিয়াকে দলের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দক্ষিণ ইসরায়েলে ৭ অক্টোবরের হামলার পর হানিয়াহ গাজায় যুদ্ধবিরতির চেষ্টার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন এবং ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করতে সহায়তা করছিলেন। কিন্তু গতকাল ৩১ জুলাই হামলায় তিনি নিহত হন। ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার ঘটনার পর সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা এখন কারা রইলেন তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মিডল ইস্ট মনিটর।
খালেদ মেশাল: তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করার প্রচেষ্টায় তাকে সংগঠনটির প্রধান আলোচক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। তিনি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছয় দিনের যুদ্ধের (সিক্স ডে ওয়ার) পর জর্ডানে পালিয়ে যায় এবং তিনি কুয়েতে চলে যান।
১৯৪৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হলে মেশাল সংগঠনের কুয়েত শাখার নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে তিনি কুয়েত ছেড়ে চলে যান। পরে তিনি জর্ডানের রাজধানী আম্মানে চলে আসেন। ১৯৯৭ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আম্মানে মেশালকে হত্যা করার জন্য একটি দুই সদস্যের হিট স্কোয়াড পাঠিয়েছিলেন। যারা কানাডিয়ান পাসপোর্ট জাল করে জর্ডানে দেশে প্রবেশ করেছিল। এজেন্টরা একটি পাবলিক রাস্তায় তার কানে প্রাণঘাতী রাসায়নিক ইনজেকশন প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল কিন্তু অপারেশনটি ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর ওই দুইজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। সেই সময়ে জর্ডানের নেতা রাজা হুসেন এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
ঘটনার পর মেশালকে সমর্থকরা ‘জীবন্ত শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেছিল এবং ২০০৪ সালে ইয়াসিন এবং তার উত্তরসূরি আবদেল আজিজ আল-রান্টিসি উভয়কেই হত্যা করা হয়। এরপর সংগঠনটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান খালেদ মেশাল। তার নেতৃত্বে হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। মেশাল ২০১৭ সালে তার মেয়াদের সীমার শেষে হামাসের পলিটব্যুরোর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং বিদেশে সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হন।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার: গাজা স্ট্রিপের মধ্যে হামাস আন্দোলনের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ইয়াসিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচিত ছিলেন। ১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে ইসরায়েল সিনওয়ারকে চার দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তিনি ২৩ বছর ধরে হামাসের নিরাপত্তা সেবা মাজদের প্রথম নিরাপত্তা ব্যবস্থার নেতৃত্ব দিতেন। ‘মাজদ’ ইসরায়েলকে সহযোগিতা করছে এমন ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করেন।
কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ার হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন এবং ইসরায়েলি সংবাদপত্র পড়তেন। বিশ্লেষকরা বলতেন, তার শত্রুকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য তিনি এই ভাষা শিখেছিলেন। ২০০৬ সালে হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের মুক্তির বিনিময়ে ২০১১ সালে ১ হাজার ৪৭ ফিলিস্তিনি বন্দীকে ছেড়ে দেয় ইসরায়েল। তাদের সঙ্গে সিনওয়ারও মুক্তি পান সে সময়। সিনওয়ার হামাসের একজন বিশিষ্ট নেতা হিসেবে তার অবস্থানে ফিরে আসেন এবং ২০১৭ সালে গাজা উপত্যকায় হামসের প্রধান নিযুক্ত হন
মোহাম্মদ দেইফ: ২০০২ সাল থেকে হামাসের সামরিক শাখা ‘ইজ আল-দিন আল-কাসাম’ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। গাজায় ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও এসব পথে ইসরায়েলে হামাস যোদ্ধাদের ঢোকার সুযোগ করে দেওয়ার কাজে প্রকৌশলীদের সহায়তা দিয়েছেন তিনি। যার ফলে হামাস যোদ্ধাদের এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে।
১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে খান ইউনিসে জন্মগ্রহণ করেন দেইফ। তিনি প্রথম ইন্তিফাদার সময় হামাসে যোগদান করেন এবং ১৯৮৯ সালে তার কার্যকলাপের জন্য ইসরায়েলি বাহিনী গ্রেপ্তার করে। তিনি ইসরায়েলি জেলে এক বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে গাজায় ফিরে আসেন। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে সালাহ শাহেদ নিহত হওয়ার পর ২০০২ সালে তার উত্তরসূরি হিসেবে মোহাম্মদ দেইফ হামাসের সামরিক শাখার প্রধান হন।
ইসরায়েল ২০১৪ সালে গাজায় দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। তখন তার স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করা হলেও তিনি বেঁচে যান। গত মাসেও এক হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন তিনি। হামাস পরে এ খবর নিশ্চিত করেছে।
তবে আজ বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, ইসরায়েলের দাবি হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, গত ১৩ জুলাই ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনিস এলাকায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় মোহাম্মদ দেইফ নিহত হন। তবে ওই বিমান হামলার পর হামাসের আরেক কমান্ডার রাফা সালেমেহ নিহত হওয়ার দাবি করেছিল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। কিন্তু তখন মোহাম্মদ দেইফ নিহত হওয়ার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
মারওয়ান ইসা: ইসরায়েলি গ্রেপ্তার এবং হত্যার প্রচেষ্টা এড়াতে জনসম্মুখে খুব কমই দেখা যায় মারওয়ান ইসাকে। এ কারণে তাকে ‘শ্যাডো ম্যান’ নামেও ডাকা হয়। হোয়াইট হাউস অনুসারে, এই বছরের শুরুতে ইসরায়েল কর্তৃক তিনি নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছিল। তবে হামাস নিশ্চিত করেনি, ইসা মার্চে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন কি না। তবে এই অধরা নেতা ২০০৬ সাল থেকে বেশ কয়েকটি হত্যা প্রচেষ্টার পাশাপাশি ২০১৪ এবং ২০২১ সালে গাজায় তার বাড়িতে বিমান হামলা থেকে বেঁচে গেছেন বলে জানা যায়।
ধারণা করা হয় দক্ষিণ ইসরায়েলে ৭ অক্টোবরের হামলার মাস্টারমাইন্ড ইসা। ২০১২ সালে দেইফের ডেপুটি হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলে হামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলেও মনে করা হয়। তিনিও ইসরায়েলি কারাগারে পাঁচ বছর কাটিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দ্বারা আবার গ্রেপ্তার হন, কিন্তু দ্বিতীয় বিদ্রোহের সময় মুক্তি পান।
হামাসের ঊর্ধ্বতন নেতা হলেও ২০১১ সালের পর থেকে মারওয়ান ইসার কোনো ছবি পাওয়া যায় না। সর্বশেষ ওই বছর তাকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের সঙ্গে একটি ছবিতে দেখা গেছে।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই