মা তুমি সবার সেরা
ড. অখিল পোদ্দার :
প্রাণীজগতের আর সবার মতোই মাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি; অগুণতি। তাই মাকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস দেখায়নি। কারণ আমার দুর্বল বাক্যের অগোচরে যদি মা ছোট হয়ে যান-এই ভয়ে, হীনমন্যতায়। কারণ মায়ের সূচকরেখার অনেক নিচে আমি। তুলনা করলে সবচেয়ে ক্ষুদ্র, নিচ ও বায়বীয় এক বস্তুকণা-অন্তত আমি। আর তিনি তো জগজ্জননী।
আমার মা হয়তো কোনদিন গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দেন নি। কিংবা স্কুলব্যাগের পকেটে টিফিনের বাকসো কিংবা পাঁচ-দশ টাকার নোট গুঁজে দেননি। কিংবা শেষবিকেলে মাটির উঠোনে জাপ্টে ধরে ঘাম মুছে দেন নি স্কুলফেরত ছেলেকে। ব্যস্ত থেকেছেন ঘরগৃহস্থালির কাজে। খোঁজ নিয়েছেন সাচ্ছন্দে ফিরেছি কিনা। দিনভর শুধু কাজই করেছেন। মোরগডাকা ভোরে উঠে প্রায় মাঝরাতে ঘুমোতে গেছেন। সকাল কিংবা দুপুরে ¯œান করার ফুরসত মেলেনি। যতোদিন গাঁয়ে থেকেছি ততোদিনই দেখেছি সন্ধ্যেবেলায় পুকুরে গেছেন। কায়িক পরিশ্রমী এই মাকে নিয়ে কী লিখব আর কী লিখব না-এই ভাবনাতেই স্মৃতি সংবরণ না করে জমা রেখেছি মনঅন্দরের সিন্দুকে।
মা আমার গাঁয়ে থাকেন। চাকরির কারণে আমার ঢাকায় থাকা। কখনোসখনো আসেন। অনেকটা বিনয় করেই উনাকে আনা হয় ডাক্তার দেখাতে। এক দু’দিন হয়তো উনার ভালোই যায়। অতপর সময় কাটে বারান্দার গ্রিল গলিয়ে বাইরে নিঃসীম দৃষ্টি দিয়ে। রবি ঠাকুরের দইওয়ালার অমল চরিত্র উনার অবয়বে। মা বোধকরি বন্দি থাকেন শহরের ইঁট-পাথরের খুপড়িতে। তবু হেসে বলবেন, এবার না হয় গ্রামে ফিরে যায়। পরেরবার এসে মাসখানেক থাকব। বাড়িতে এই সমস্যা ওই সমস্যা। তাঁর অনুপস্থিতে পুরো সংসার ভেসে যাচ্ছে। আমার কাছে বিষয়গুলি খুব অগুরুত্বপূর্ণ হলেও মার কাছে প্রত্যেকটি ঘটনা সমান মূল্যবান। উনার অনুপস্থিতে গরুগুলোর হয়তো বেহাল অবস্থা। মাঠে হয়তো ফসলহানি ঘটছে। বাগানবাড়িতে তছরুপ করছে পার্শ্ববর্তী হিংসুকেরা। বাঁশ কেটে নিয়ে যাচ্ছে খালপাড়ের লোকজন-এসব মিলে রাজ্যের চিন্তা উনার মাথায়। যেহেতু মা আমার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা কিংবা চাকরিজীবী নয়। তাই মা’র সা¤্রাজ্য এসব নিয়েই। মাকে যদি স্মরণ করে দেই যে, এবার এসে তো এক মাসই থাকার কথা ছিল ঢাকাতে। কারণ ডাক্তারকে ভাল করে দেখাতে এই সময়টুকু থাকতেই হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। অতপর আবার দেখবে। তাই অল্পদিনে যাওয়া হচ্ছে না। এসব শোনার পর মাকে খুব অসহায় লাগে। কারণ তাঁর কাছে এই শহর একটা আলকাতরার টিনের বাকসো। আর আমার বাসা তাঁর কাছে পুরোদস্তর সাবজেল। থমাস হার্ডির ‘দ্য রিটার্ন অফ দ্য নেটিভ’ উপন্যাসের গ্রামচিত্র ভেসে ওঠে। চোখে ভাসে আমার ছায়াসুনিবিড় গরিব গ্রামের মায়াবিচিত্র। মা তাই ফিরে যেতে চান সেখানে। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকের মানুষগুলোর অনেক ক্ষুধা ছিল সত্য কিন্তু গ্রাম নিবিড়তা হারায়নি। সুতরাং মা ফিরে যাক। উঠোনে পা রাখলেই মা হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবেন কিছুটা। মা আমাকে ভালবাসেন কিন্তু ভাড়াটে বাসাটি তার কাছে জঞ্জাল। যেমন আমার কাছে জঞ্জাল ভিঁনদেশ, অতিউন্নত দেশও।
মা কখনো হাসপাতালে রাতযাপন করেননি। বয়সের এই সময়ে ডাক্তার দেখান মাঝেমধ্যে। কোন রোগ উনাকে পরাস্ত করতে দেখিনি। কিন্তু ছোটবেলায় আমার অনেক বড়সড় ব্যামো হতো। জ্বর আর কলেরা তো ফিবছর লেগেই থাকতো। আমার অজস্ব্র কষ্ট তাই তাঁর ব্যাংকে জমা আছে। আমার নীলবেদনার শতরঞ্জিগুলো ভাঁজ করে রেখেছি উনার হৃদয়জুড়ে। বিনিময়ে নিয়েছি অনেক অগুণতি আদর ভালোবাসা আর ভাষাহীনতার প্রেম। মা আমার জীবনমরণের হাটে সুখ বিলিয়ে দুঃখ কিনেছেন জেনেশুনে। সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি যখনই জেগে উঠেছি, মাকে পেয়েছি সদাজাগ্রত। শিয়রের পাশে। জলপট্টি দিয়েছেন, বাতাস করেছেন কিংবা কনকনে রাতে পাশে বসে থেকেছেন। ডায়রিয়া-কলেরা আমাকে যখন প্রায়শই কাবু করেছিল।
ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত অন্যদের মতোই মাকে নিয়ে আমার অগুণতি স্মৃতি। বলতে পারেন অজস্র উনার সব রান্নাই আমার ভাল লাগে। কিন্তু মূলা দিয়ে ডিম রান্নার ঘ্রাণটা এখনও মস্তিষ্ক জানান দেয়। কচুর সঙ্গে ইলিশ মাছ। সরিষা বেঁটে ওলের ডাঁটা। মাসকলাই ডালের বড়ি, পুঁটি মাছ আর পালং শাকের কথাই বা ভুলি কী করে! গল্পশুনে এই ব্যঞ্জনটা বহুবার আমার স্ত্রী নিজে ও বুয়া-খালারা রান্না করেছে। ব্যর্থ তারা। অযথাই অপচেষ্টা। গ্রামের বাড়িতে গেলে আমার স্ত্রী মাকে ডিম রান্নার কথা বলতে অন্তত ভোলেন না।
আমার মা আমাকে কোনদিন গায়ে হাত তোলেননি। চরম বদমেজাজী বাবাকে আমরা ভাইবোনেরা সবসময় এড়িয়ে চলেছি। অযথাই বাবার মাথা গরম করতে দেখেছি। সবকিছুতেই উনার খুঁত ধরার অভ্যাস। যেটি এখনো বিদ্যমান। মা কিন্তু চুপচাপ। আবার ভাইবোনদের স্বার্থে লাগলে মা চরম প্রতিবাদী বাবার বিরুদ্ধে। বিশ্বাস হতে চায়না। বরফখন্ড হঠাৎ জ্বলে ওঠে সূর্যের মতোই, রোদ্দুর ছড়ায়। আমাদের সবার বড় ভাই তারপর বোন অতপর আমি। আমার দশ বছরের ছোট আরেক বোন। বয়সের মধ্যে রিজনিবল একটা গ্যাপ আছে। ভাই কিংবা বোনদের কেউই মেজাজী নন। ফ্যামিলিতে দূর্ণাম শুধু আমাকে নিয়ে। বাবারও অনুযোগ আমাকে নিয়ে। কারণ তিনি চান না তাঁর বাবা কিংবা তাঁর মতোই তাঁর সন্তানেরা কেউ বদমেজাজী হোক।
কোন অনুষ্ঠানে সবাই বাড়িতে ঐক্যবদ্ধ হলে হৈ হুল্লোর হতো সারাক্ষণ। কিন্তু বাবা বাড়ির উঠোনে পা রাখলেই ফুটো বেলুনের মতো মিইয়ে যেত সবাই। আমার মনে পড়েনা ভাইবোনদের কেউ আমরা বাবার সঙ্গে একবৈঠকে খেয়েছি কখনো। কিন্তু মা’র সঙ্গে আড্ডার শেষ নেই। অন্তত পুজোর আগেও জামার ছিটকাপড় কিংবা প্যান্ট কেনার আবদারটুকু মাকেই করতে হয়েছে আমাদের হয়ে। অভাবের সঙ্গে বাবার মেজাজ যুক্ত করে প্রাপ্তির যোগফল যা হতো তা রীতিমতো বেদনাদায়ক। তাই মাকেই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিয়েছি আমরা। এদিকসেদিক করে দু’চার আনা মা যদি জোটাতে পারতেন সেটিও শেষমেশ আমাদের জন্য ব্যয় করতে হতো তাঁকে। আমাদের বউয়েরা এখন যেভাবে তাঁদের শখ আহ্লাদ মেটায় তা আমার মায়ের সঙ্গে তুলনা করলে নারীবাদীরা অনেকেই হয়তো নাখোশ হবেন। কারণ আমার মা’র কোন শখ পূরণ করতে দেখিনি বাবাকে। মাসের পর মাস একই শাড়ি পরতে দেখেছি তাঁকে। এমনকি ছেঁড়া শাড়িও চোখে পড়েছে আমার। শুধু আত্মীয়বাড়ি গেলে ভাল শাড়ি পরতেন। তাঁরা বলতেন ‘তোলা শাড়ি।’
মামাবাড়ির বৃহত্তরগোষ্ঠীতে সবার বড় আমার মা। আমার ছোট বোনের সঙ্গে বয়সের ফারাক যেহেতু ১০ বছর সেহেতু প্রায়শই নানান আনুষ্ঠানিকতায় মার সঙ্গে আমাকে মামাবাড়িতে যেতে হতো। এক ঝাঁক মাসী মামার সন্তানদের তুলনায় পরীক্ষার রেজাল্ট একটু বেশিই ভালো হতো আমার। সে সুবাদে মামাবাড়িতে বেশ কদর ছিল। কিন্তু পড়ালেখা নিয়ে মা কখনো চাপাচাপি করেননি। উনার মৃদু শাসনই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমাদের কুষ্টিয়া থেকে মামাবাড়ি রাজবাড়িতে গেলে বইও সঙ্গে নিয়ে যেতাম। সিলেবাস শেষ হলে মায়ের ছোটবেলার সবুজ সাথী বই পড়তাম। মামাবাড়ির বাক্সপেটরা খোঁজ করে মার কিছু বই উদ্ধার করেছিলাম। ক্লাসের বদলে সেগুলো পড়তেই বেশি আগ্রহ ছিল। আর মামাবাড়ির স্মৃতি তো বইপুস্তকের গল্পের মতোই। ইয়া বড় পুকুর, আমবাগান, জামতলা, বাঙ্গি-তরমুজের খেত, ধানের আল ধরে ছুটে চলা, সাইকেল চালানো। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলেও বোধকরি আমি স্বাধীন করেছি আমার মামাবাড়ি। হয় বহরপুর নয়তো রাজবাড়ি রেলস্টেশনে নেমে খররোদের মধ্যে কখনো রিক্সা কিংবা খানাখন্দের রাস্তা ধরে হেঁটে চলার স্মৃতি আমৃত্যু ভোলার নয়। সেভেন এইটে ওঠার আগ পর্যন্ত মা’র ছায়াসঙ্গীর মতোই ছিলাম আমি।
মা’র পরিপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়েছি আমি। মা আমার পুরোদস্তুর বার মাসে তের পার্বণ নিয়ে এখনো ব্যস্ত। এসব নিয়ে আমার কিছুটা রিজার্ভেশন থাকলেও আমার প্রতি মা’র কোন রিজার্ভেশন নেই। মা হয়তো সিগুমুন্ড ফ্রয়েড কিংবা জ্যঁ পল সার্ত্রে পড়েননি। ম্যাজিক রিয়েলিজম, পোস্টমর্ডানিজম কিংবা সুররিয়ালিজমের ব্যাখ্যাও তাঁর জানার দরকার নেই। মা যেহেতু চৈতন্যদেবকে জানেন, সুফিবাদীদের দেখেছেন কিংবা বিষ্ণু অবতারে আস্থা আছে। তাই তাঁর ডারউইন ল্যামার্ক থালেস পড়বার প্রয়োজন পড়েনি। সুতরাং মা’র কাছে আমার চেতনা উনার চিৎশক্তিতেই নিবিষ্ট। তাই বুঝি আজ পর্যন্ত উনার সঙ্গে কোনদিন আমার মনোমালিন্য হলো না।
মা তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। জেনে রেখো তোমার চার সন্তানের মধ্যে শুধু আমার ব্লাড গ্রুপই তোমার সঙ্গে মিলেছে। এ দেহের সমস্ত রক্তবিন্দুতে তোমার অধিকার। তুমি বেঁচে থেকো আমার চেয়ে অনেক বেশি দিন। তুমি না থাকলে এ পৃথিবীতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেবে। সবুজ আর সতেজতা হারাবে ধরিত্রি। জল ও বায়ুতে তুমি মিশে আছো মা। এই মাটিতে তোমার পা পড়েছিল বিধায় মানুষ চাঁদের মাটিতে হেঁটেছে। পৃথিবীর মৌলিক উপাদানগুলো তুমি ছুঁয়েছো বলেই টিকে আছে এত্তোবড় ভারি গ্রহ। শুধু তোমার আকর্ষণে। মা তুমি সবার সেরা।
লেখক : হেড অফ ইনপুট, একুশে টেলিভিশন লি, ঢাকা