মা, কতোদিন পর তোমাকে লিখছি
॥ আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ॥
মা, ক’দিন যাবত তোমাকে খুব মনে পড়ছে। প্রতিদিন জেগে থাকার এমন মুহূর্ত নেই যে আমার চোখে তোমার মুখ ভাসে না। যখন একা থাকি তোমার সাথে কাটানোর সময়গুলো স্মরণ করলেই আমার চোখ আর বাধা মানে না। তোমার অনুপস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠে। তুমি চলে যাওয়ার পর দশটি বছর আমি কারো সাথে তোমার স্মৃতি নিয়ে কোন কথা বলিনি। তুমি না থাকায় আমার মাঝে যে শূন্যতা ও অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়েছে সে দুঃখে কাউকে অংশীদার করিনি। কি করে বলি? আমার যতো কথা তো তোমাকেই বলেছি। তোমার কাছে না বলার কোন কথা ছিল না। সাময়িক কিছু বিরতি ছাড়া আমার জীবনের ৪৮টি শীত গ্রীস্ম বসন্ত তোমার সাথেই কেটেছে। সন্তান বড় হয়ে গেলে মা বাবার সাথে এক ধরণের ব্যবধান সৃষ্টি হয়, আমি দুই সন্তানের পিতা হয়ে যাওয়ার পরও তোমার সাথে আমার সে ব্যবধান হয়নি। আমি দিব্যি তোমার গালে গাল ঠেকিয়ে বসে থাকতাম, তুমি উঠানে হাঁটলে এক হাতে তোমার কোমর আঁকড়ে আমিও হাঁটতাম। শেষ পর্যন্ত আমি তোমার অবোধ শিশুপুত্রই ছিলাম। আমার বয়স বেড়েছে, কিন্তু আমি বড় হইনি। আমি চিৎকার করে ‘মা’ ‘মা’ করে তোমাকে ডাকতাম। আমার ছেলেমেয়েও এ দৃশ্য দেখে হাসতো। কারণ, ওরা ছোট হলেও ওদের মায়ের সাথে এমনটি করে না, বা কাউকে মায়ের সাথে এমন করতে দেখেনি।
তোমাকে বেশী করে মনে পড়ার কারণ বিদেশ বিভূঁই এ অল্প সময়ে ঘনিষ্টজনে পরিণত হওয়া ডা: ওয়াজেদ খানের মা মারা গেছেন। দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। নব্বই এর উপর হয়েছিল তার বয়স। কিন্তু সুস্থ ছিলেন। গতবছরই ওয়াজেদ ভাই সপরিবারে দেশে গিয়ে মাকে দেখে এসেছেন। তিনি নিজে ডাক্তার হওয়ায় বার্ধক্যে মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য নিউইয়র্ক থেকে নিয়মিত পাঠাতেন। প্রায় প্রতিদিন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলতেন। এর ব্যতিক্রম হতো না। ক’মাস আগেও তার দেশে যাওয়ার কথা ছিল। দিনক্ষণ স্থির। টিকেটও কাটা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ বিপত্তি ঘটলো। তিনি প্রবাসীদের জন্য যে সংবাদপত্রটি বের করেন, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ এর কম্পিউটার ক্রাশ করলো। তার দেশে যাওয়া হলো না। কিন্তু যেদিন খবর এলো যে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে তার নবতিপর মা চেতনালুপ্ত হয়েছেন, তাকে জরুরী ভিত্তিতে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এনে হাসপাতালে ভর্তি করার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি, তখন তিনি ভেঙ্গে পড়লেন। ভাবী তাকে তাগিদ দিচ্ছিলেন দেশে যেতে। কিন্তু তিনি হতাশার সুরে বলছিলেন, গিয়ে কি আর পাবো। আমিও তাকে বললাম আমার বিশ্বাস থেকে যে মায়ের পাশে উপস্থিতি পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন। কারণ, তোমার বিদায় নেয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে আমি দেশে ফিরেছিলাম। সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর একটি সেমিনারে যোগ দিতে যেদিন দিল্লি গেলাম তুমি সুস্থ ছিলে। অ্যাজমা ছাড়া তোমার আর কোন শারীরিক সমস্যা ছিল না। সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে আরো একজন অংশ নিয়েছিলেন, ড. আতিউর রহমান, তিনি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর। সেমিনার শেষে ড. আতিউরের সাথে দেশে ফিরলে তোমার সাথে আরো কিছু সময় কাটাতে পারতাম। কিন্তু রয়ে গেলাম আরো ক’দিন। দিল্লিতে এতোবার গেছি, তবুও মোগল দিল্লিতে ঘুরে আমার ক্লান্তি আসে না। ফেরার পথে দিল্লি থেকে কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌছে দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষা। লাউঞ্জে বসেই এক তরুণ ভারতীয় বাঙ্গালী আইটি এক্সপার্টের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তার মাথার চুল কামানো, অল্পদিন আগে তার বাবা মারা গেছেন। তিনি তার কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবার ঢাকা যাচ্ছেন, তার কোম্পানির ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দিতে। তার মাঝে এক ধরণের ভীতি কাজ করছে। বিএনপি মাত্র কয়েক মাস আগে সরকার গঠণ করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নিগ্রহের কাহিনী ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচারিত হচ্ছে। তিনি নাকি এমন খবরও পড়েছেন যে বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে সব হিন্দুকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল।
আমি তাকে আমার মতো করে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করি। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম বিবাদ নেই। ভারতের মতো দাঙ্গার ঘটনা কখনো ঘটেনি। ভারতে হিন্দুদের নিজস্ব জাতভেদের কারণে যে সমস্যা বাংলাদেশে সেটিও অনুপস্থিত। তবে বাংলাদেশে সমস্যা একটিই, তা হলো যে রাজনৈতিক দলটি নিজেদেরকে হিন্দুদের ত্রাণকর্তা ও তাদের স্বার্থের দেখাশুনাকারী বলে মনে করে সেই দলটি ক্ষমতার গগণ থেকে ছিটকে পড়ায় তারাই নতুন সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু দলনের কল্পকাহিনী ছড়াচ্ছে এবং ভারতীয় মিডিয়া তা লুফে নিচ্ছে। কিন্তু ভদ্রলোকের দ্বিধা কাটে না। ঢাকায় ফ্লাইট পৌছবে রাত ১০টার দিকে। তিনি উঠবেন হোটেল পূর্বাণীতে। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতেও তার শংকা। আমি বললাম, আমাকে নিতে যে গাড়ি আসবে আমি সে গাড়িতে আপনাকে হোটেলে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। তোমার আদরের নাতি ওয়ামী এয়ারপোর্টে এসেছিল আমাকে নিতে। আমি বললাম, মামা, আমাকে বনানীতে নামিয়ে দিয়ে একটু কষ্ট করে মতিঝিলে গিয়ে ভদ্রলোককে পূর্বাণীতে পৌছে দিতে হবে। কোন কাজে ওয়ামী ‘না’ বলতে শিখেনি। পথেই ফোন এলো, তুমি অসুস্থ। তোমার ভাতিজা ডা: জোশ জানিয়েছে অক্সিজেন দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল এ জন্যে শেরপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তোমার পুরো চেকআপের জন্য ঢাকায় কোন হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারিনি। তুমি তখন শেরপুর হাসপাতালে। ভদ্রলোককে ওয়ামীর জিম্মায় দিয়ে বাসায় উঠছি। চারতলায় উঠা যেন এভারেষ্টে উঠার মতো কষ্টকর। তোমার মেয়েকে ফোন করে সব খবর পেলাম। চারদিন থেকে তোমার শরীর খারাপ, সবাইকে মানা করেছো, যাতে আমাদেরকে তোমার অসুস্থতার কথা না জানায়। জোশ তোমার অবস্থা দেখে জানাতে বাধ্য হয়েছে। অক্সিজেন দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল। সদর হাসপাতাল ছাড়া শেরপুরে আর কোথায়ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। তোমার মেয়েকে বললাম, রাতেই যাবো। বাবুলকে সাথে নিয়ে চলে আয়।
হোটেলে ভদ্রলোককে পৌছে তোমার মেয়েকে নিয়ে গাড়ি বনানীতে এলো রাত বারোটার পর। তোমার পরিচিত, আমাদের বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য ড্রাইভার রফিক। তোমাকে নিয়ে কতো ঢাকা-শেরপুর যাতায়াত করেছে। শেরপুর পৌছলাম ভোর চারটায়। বাসায় একটু নেমে তিন ভাইবোন গেলাম হাসপাতালে। তোমার তৃতীয় ছেলে আজাদ জন্ডিসে নিজেই শয্যাশায়ী। কিন্তু ঢাকায় খবরটা দেয়নি কেন? তুমি মানা করেছিলে সেজন্য? মাথায় এটুকু বুদ্ধি নিয়ে সে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানগিরি করেছে? ভোর রাত। তখনো ফযরের আজান পড়েনি। আশা করেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে থাকবে। আমরা দেখে চলে আসবো। সকালে একটা এম্বুলেন্স ঠিক করে ঢাকায় আনবো। কিন্তু তুমি বেডে বসে ছিলে। তোমার দেখাশুনার জন্য হাকিম জেগে ছিল, আর বেডের এক প্রান্তে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মিজান। আমাদের দেখে তোমার ম্লান মুখে হাসি ফুটে উঠলেও বলছিলে, কতো মানা করেছি তোদের যাতে খবর না দেয়। সারা রাত রাস্তায় গেছে, এখন বাসায় গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।। আমি তোমাকে বকতে শুরু করেছি, ঢাকার হাসপাতালে তোমাকে রাখতে পারলাম না। এখন এই নোংরা হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। তুমি তোমার গাই এর জন্য শেরপুর ছেড়ে ঢাকায় যেতে চাও না, এখন তোমার গাই কে দেখছে? এবার তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো, আর শেরপুরের নাম মুখে আনতে পারবে না।
বাবুল একটা নেবুলাইজার সাথে নিয়েছিল। ওটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তাড়াহুড়ার কারণে তা জেনে নেয়নি। নার্সদের ডাকা হলো, তারা কখনো নেবুলাইজার ব্যবহার করেনি। ডাক্তার এলেন, তিনিও নেবুলাইজারের প্রয়োগ জানেন না। আমরা তোমার হাত পা বুক পিঠে হাত দিয়ে দেখছিলাম। তুমি ঘামছিলে, টাওয়েল দিয়ে বুক পিঠের ঘাম মুছে দিলাম। হঠাৎ একটু অস্থির মনে হলো তোমাকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অক্সিজেন কি নার্সরা এসে দেয়, তুমি বললে নার্স লাগে না, নিজেই নেই। অক্সিজেন মাস্ক টেনে নাকের উপর পরলে, হাকিম অক্সিজেন ছাড়লো। কয়েক মিনিট। এরপর সহসাই তুমি বেশী অস্থির হয়ে উঠলে। মাস্ক খুলে বললে, এমন লাগছে কেন। বোধহয় মারা যাচ্ছি। ডাক্তার ডাকো। দৌড়ে নিচতলায় ডাক্তারের রুমে গেলাম। ডাক্তার এলেন, পালস দেখলেন। তোমার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো মৃদু নিঃশ্বাস পড়ছে। ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশনের নাম লিখলেন। হাসপাতালের সামনে সারি সারি ওষুধের দোকান, সব বন্ধ। হাকিমকে বললাম, দরজায় জোরে ধাক্কা দিয়ে, চিৎকার করে ডেকে দোকানিদের জাগিয়ে ইঞ্জেকশনটা আনো। এর উপর হয়তো তোমার দাদীর জীবন নির্ভর করছে। ডাক্তার দ্রুত ইঞ্জেকশন দিলেন। বুকে হালকা পাম্প করলেন। আমি প্রাণপণে তোমার পা ডলছি। তোমার মেয়ে তোমার শিয়রে। বাবুল অস্থিরভাবে হাঁটছে। ডাক্তার শেষবার পালস দেখে বললেন, নেই। আমার মনে হচ্ছিল, এ হতে পারে না। তুমি কতো মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছো, এমন বিনা চিকিৎসায় তুমি যেতে পারো না। তোমাকে তো ঢাকায় নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার সাথে আমার না বলা অনেক কথা আছে। আমার কথা না শুনে কি করে যেতে পারো তুমি?
হাকিম চিৎকার করে কাঁদছিল। মিজানও কান্নাকাটি শুরু করেছে। আমরা উপস্থিত তিন ভাইবোন কাঁদিনি। ঘটনা আকস্মিকতা আমাদের বিমূঢ় করে দিয়েছে। বাবুল বোতলের মুখ খুলে নিজের মাথায় পানি ঢেলে স্ট্রেচারে শুয়ে পড়লো। মিজানকে বললাম, ওকে সামলাও। আমাদের জন্যে কষ্ট করে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেছো, আমরা এলাম, মাত্র পনের মিনিটেই তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। তোমার মাথা ধরে রেখেছে তোমার মেয়ে। আমার মাথা তোমার দুই পায়ের উপর। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। ফজরের আযান হচ্ছিল। একটু পর পহেলা ফাল্গুনের সূর্যোদয় হবে। সাতচল্লিশটি বসন্তের আগের বসন্তের প্রথম দিনে আমার জন্ম হয়েছিল। সেদিন মনে হয়েছে আমাকে জন্ম দিতেই তোমাকে বিদায় নিতে হলো। এর পরের প্রতিটি পহেলা ফাল্গুনে একথাটিই আমার মনে প্রথম জেগেছে।
হাসপাতালের দোতলা থেকে তোমাকে নামলাম। সুপরিসর পাজেরো। পিছনের আসনে উঠে তোমার মাথা আমার কোলে নিলাম। পা দু’টি তোমার মেয়ের কোলে। বেঁচে থাকতে তো তোমার মাথা পা কোলে নিতে পারিনি। আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ১৯৬২ সালে শহরের যে বাড়িতে তুমি এসেছিলে তখন তোমার বয়স ২৭ বা ২৮ বছর, ৪০ বছর পর ২০০২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী সে বাড়িতে যখন তোমাকে নেয়া হলো তখন তুমি বোধের জগতের বাইরে। আব্বা প্রতিদিনের অভ্যাসমতো তোমাকে ডাকছেন। তিনি সুস্থ নন। অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ। শেষ পর্যন্ত খালেক তাকে সত্যটা বললো। আব্বার আর্তনাদে অন্যান্যের কান্না চাপা পড়ে গেল। তার ঘর থেকে ছুটে এসে দু’হাতে তোমার মুখ ধরে বলছিলেন, আমার আগে তুমি চলে গেলে! আমাকে বললেন, তোমার মায়ের কবরের পাশে আমার কবর দিয়ো। দাদী মারা যাওয়ার পর আব্বা আমাকেই বলেছিলেন তোমার দাদীর পাশে আমাকে কবর দিয়ো। আজাদকে বললাম গ্রামের বাড়িতে খবর পাঠাতে যাতে দাদীর কবরের পর একটি কবরের জায়গা রেখে তোমার কবর খোড়া হয়। দু’জনের পাশেই থাকতে পারবেন আব্বা।
দুঃসংবাদ ছড়াতে সময় লাগে না। সূর্য আলো ছড়ানো শুরু করতেই লোকজন আসতে শুরু করলো। নারী পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ, আত্মীয় অনাত্মীয়, হিন্দু মুসলিম, সকল বয়সের মানুষ। তুমি এতো মানুষকে কি করে জানতে? লোকজন তোমাকে এতো ভালোবাসতো?
ওয়াজেদ ভাই শেষ পর্যন্ত বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার মেয়ে বুশরা ডাক্তারী পড়ছে। সে মেইল করে জানিয়েছে যে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় নিশ্চিত হয়েছেন যে, মানুষ চেতনাহীন হয়ে পড়লেও আপনজন কাছে থাকলে ও কথা বললে তাদের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। বহু বছর আগে দার্শনিক চিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েডও অচেতন মানুষের চেতনা সম্পর্কে এর কাছাকাছি তত্ত্ব দিয়েছেন। তার তত্ত্ব বিতর্কিত ছিল। কিন্তু এখন গবেষণা এতো সুক্ষ্ম যে বিতর্কেও অবকাশ কম। ওয়াজেদ ঢাকায় তার মায়ের সেবায় যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদেরকে কথাটি বলছিলেন, আর চোখ মুছছিলেন। কখনো তাকে সান্তনা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছিলাম। আমার মন জুড়ে তখন তুমি। আমার চোখও ভিজে উঠছিল। উনি দূরে থেকেও যেভাবে মায়ের খোঁজ নিতেন, সেবা করতেন, আমি তো কাছে থেকেও তোমার সেবা করতে পারিনি। কখনো ভাবিনি যে তোমার বয়স হয়েছে, তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। যে বয়স থেকে মানুষের সবকিছু মনে থাকে তখন তোমাকে যেমন দেখেছি, বহুবছর পরও একই রকম মনে হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে তোমার কোন পরিবর্তন আমার চোখে পড়েনি। প্রায় ৫০ বছর আগে তোমার কানে পাথর বসানো দুল, পরনে জর্জেট শাড়ি এখনো আমার চোখে ভাসে। কি করে তোমার পরিবর্তন বুঝবো আমি? বছর ত্রিশেক আগে জরুরী কাজে বাড়ি গেছি, ভোরেই ঢাকায় ফিরতে হবে। তোমার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে গেছি। খাওয়ার পর বললাম, শাড়িটা পরতে। তুমি বললে, পাগল, এখনই পরতে হবে, পরে পরবো। ভোরে ডেকে দিতে বলেছিলাম। তোমার ডাকে চোখ খুলেই দেখি, তুমি শাড়িটা পরেছো। তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তুমি জানতে শাড়িটা পরলে আমি খুশী হবো। আমার এ আবদার আর কারো কাছে নেই, মা। সেই তুমি নেই। কিভাবে আমার দিন মাস বছর কাটে তা যদি তুমি বুঝতে পারতে আমার মা হীন অসহায়ত্ব কিছুটা লাঘব হতো। কিন্তু একটি ব্যাপারে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, আল্লাহ আমার একটি প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। সে প্রার্থনাটি ছিল, কোন কারণেই যাতে তোমাকে আমার মৃত্যু দেখতে না হয়। যে কোন মা বাবার কাছে সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর অভিজ্ঞতা আর কিছু হতে পারে না।
জীবনে কোন মৃতদেহ স্পর্শ করিনি। কারো লাশ কবরে নামাইনি। কিন্তু তোমার জন্যে নামলাম -- আমি আর তোমার বড় ছেলে। বার বার ইচ্ছা হচ্ছিল, তোমার মুখটা আর একবার দেখি। একটু পরই তো মাটির নিচে চাপা পড়ে যাবে তুমি। আর কোনদিন দেখতে পাবো না। ইচ্ছাটা কিভাবে দমন করলাম, জানি না। তোমাকে কবরে স্থাপন করে উপরে উঠে এলাম। নিয়ম মাফিক লোকজন কবরের উপর বাঁশের ফালি, চাটাই রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। এ পৃথিবীর আলো আর তুমি দেখবে না। চির অন্ধকারের জগতে রেখে চলে এলাম। সারা দিনের চেপে রাখা কষ্ট আর বাধা মানলো না। সশব্দ কান্না আর অশ্রুর প্রবাহে রূপ নিল আমার যন্ত্রণা। সেই অশ্রু ধারা এখনো থামেনি। তুমিহীন পৃথিবীতে এখনো তোমার স্মৃতি এবং তোমার জন্য অশ্রু বিসর্জনই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে আছে, মা।