মা আমার ভুবনজয়ী.......
॥ স্বপ্না চক্রবর্তী॥
মেয়েটি ঋতুবর্তিও হয়নি তখনো। লাল শাড়িতে টুকটুকে বউটি যখন ভাটির নৌকায় চড়ে উজানে শ্বশুড় বাড়িতে আসলো তখন গ্রামের লোকজনের সেকি উচ্ছাস। সারা গ্রামে তখন শুধু মেম্বার বাড়িতেই একটা টেলিভিশন আছে। সেখানেই তারা দেখেছে চিত্রনায়িকা সাবানার সাদাকালো সিনেমাগুলো। কিন্তু এ কি! সাবানা যে লাল শাড়িতে আজ তাদের গ্রামের বউ! ভুল ভাঙলো কিছুদিনের মধ্যেই। না এ সাবানা নয় ঠাকুর বাড়ির মেজো বউ। পিঠ ছড়ানো ঘন কালো চুল আর টুকটুকে লাল গায়ের বরণে অনেকেরই বাক্য বন্ধ হয়ে যেতো বউটিকে দেখে।
বড় ভাসুর আর জা গ্রামের বাড়িতে না থাকায় ১৩ বছরের মেয়েটির কাঁধেই তখন ১৫-২০ জনের পরিবারের রান্না-বাড়াসহ যাবতীয় সব কাজের দায়িত্ব। সারা গ্রামে টিউবওয়েল তখন মাত্র একটা। কলসী খাকে সেখান থেকে খাবার জল নিয়ে এসে বাকি কাজটা বাড়ির পুকুরেই সারতে হতো তাকে। পুকুর ঘাটে শান বাধানো নাই চালিতা গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি করা একটা পাড়। তাই একদিন একগাছি পিতলের থালা বাসন ধুতে গিয়ে পা পিছলে সেকি কান্ড! একবার নাকি রাত্রি বেলা পুকুর থেকে বাসন ধুয়ে ফেরার পথে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হবার উপায়। সেই থেকে বাড়িতে শ্বশুড়ের কালি পূজার মানত।
দিন যায় বছর যায়। সংসারের কাজের ভিতর কখন মেয়েটি মহিলা হয়ে উঠে কেউই বুঝতে পারে না। অনেক ঠাকুর-দেবতাকে ডাকার পর হয় সে প্রথম সন্তানের মা। মায়ের মতোই টুকটুকে লাল ছেলে সন্তান। আবারো দিন যায়, সময় যায়। গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের মতো মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে ওঠা বউটি পর পর আরো দুইটি সন্তানের মা হয়। এবার কন্যা সন্তান!
মায়ের সাথে লেখক..
একদিন দুপুরের পর ঘাট থেকে থালাবাসান ধুয়ে বাড়ির পথে যাবার মাঝেই শুনতে পারল চিৎকার চেচামেচি। কাছে গিয়ে বুঝল স্বামী আর দেবরদের মধ্যে আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে কথা কাটাকাটি। ভাবল এ এমনিতেই মিটে যাবে। কিন্তু না মিটল না। এই কথা কাটাকাটির জের ধরেই ১৩ বছর বয়সে শুরু করা তার সাধের সংসার থেকে তাদের আলাদা করে দেয়া হয়। স্বামীও নাছোড়বান্দা। তিনি আর এই গ্রামেই থাকবেন না। জেলা শহরে ২৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে একটা একরুমের বাসা ঠিক করে আসলেন বউ ছেলেমেয়েকে নিয়ে যেতে।
একান্নবর্তী পরিবার থেকে এক ঝটকায় মফস্বল শহরের মাটির মেঝে আর টিনের চালের এক রুমের একটি ঘরে ঠাই হলো তার। আবারো শুরু হলো তার নতুন করে সবকিছু সাজানোর পালা। এবার আর ১৫-২০ জন নয় শুধু মাত্র তারা ৫ জন। রাতে বাপের বাড়ি থেকে দেয়া বিয়ের খাটটাতেই সবার ঘুমাবার জায়গা করে নিজে মাটিতে একটা চাটি বিছিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা। দিন শুরু হলেই নতুন করে সংসার সাজানোর আয়োজন...চলছিল বেশ....!
কিন্তু কপালে যেন সইল তার এ সুখও! শীত এগিয়ে আসছে! ছেলেমেয়েগুলোর গরমের কাপড় নেই তেমন একটা তাই দুুপুরের খাবারের পর কুর্শি-কাটা আর উল দিয়ে এক বিকালে বড় মেয়েটির জন্য একটা সোয়েটার বানাচ্ছিলেন আর পাশের ঘরের বউদের সাথে গল্প করছিলেন। তখনি পাড়ার একটি ছেলে এসে জানালো তার ছেলেটি পুকুরে পড়ে গিয়েছে। পায়ে কাটা ঢুকেছে। হায় হায়..এখন কি করবেন? নতুন শহর তার উপর স্বামী কোথায় আছেন নিজেও জানেন না। সেই একরুমে ঘরে এসে ঢুকেছিলেন তারপর থেকে উঠানে কাপড় শুকাতে দেয়া ছাড়া ঘর থেকে বের হয়নি কখনো। কিন্তু এখন কি করবে? যে পাড়ায় তাদের বাস সেখানকার সবাই মিলেই ছেলেটিকে পাড়ার এক হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল চিকিৎসার জন্য। কিন্তু যা হবার তাই হলো। সাত দিনের মাথায় ভুল চিকিৎসায় এত সাধনার ছেলেটি চলে গেল পরপারে!
বউটি তখন আধাপাগল! কখনো বেধে রাখতে হয় খাটের খুটির সাথে, কখনো পাড়ার অন্য ছেলেদের নিয়ে এসে তাকে বোঝাতে যে এটাই তার ছেলে। কিন্তু তবুও দিন যায় বছর যায়..!
আবার তাদের ঘরে আসে আরেকটি ছেলে সন্তান। বড় ছেলে হারানোর দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলতে পারে বউটি। এরই মধ্যে একদিন ভুল করেই আবারো মা হতে চলে বউ। কিন্তু এবার আর অন্য বারের মতো আনন্দ নয় কিসের যেন শঙ্কা! সময়ের পরিক্রমায় ছোট্ট আরেকটি ফুটফুটে কন্যার জন্ম হয়।
এবার সংসার পরিপূর্ণ...! সাজানোও হয়ে গেছে বেশ। ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করতে পারলেই জীবনে আর চাওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু বিধি বাম! এরই মধ্যে এক বৈশাখে কাল বৈশাখির মতোই বউটির স্বামীটি আক্রান্ত হয় অজানা অসুখে। অসুখ এমনই কাল হয়ে ওঠে ডাক্তার বদ্যি কেউই কিছু করতে পারল না। বাঁচানো গেল না স্বামীকে। এক সকালে লাল টুকটুকে বউটির গায়ে গ্রামের মহিলারা জড়িয়ে দিলেন সাদা থান।
ছোট মেয়েটির বয়স তখন মাত্র ৩ মাস আর বড়টির ১৫ বছর! স্বামী বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে গিয়েছিলেন তাই তার বউ ছেলেমেয়েরও এই বাড়িতে থাকার কোনো অধিকার নেই বলে সাফ জানিয়ে দিলেন শ্বশুড় আর দেবররা। এখন এদের নিয়ে কোথায় যাবে সে??
ফিরলেন শহরের সেই ছোট্ট বাসায়। ১৫, ১৩, ৮ বছর আর ৩ মাস বয়সী ৪ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বউটি তখন শুধুই মা, একমাত্র অভিভাবক। ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে হলে তাকে এবার যুদ্ধ করতে হবে। নিজের সাথে, সমাজের সাথে, সময়ের সাথে। যে যুদ্ধের কথা হয়তো স্বপ্নেও কখনো ভাবে নি সে। লড়াইটা একাই করতে হয়েছে তাকে।
পরিবারের সবাই
কিন্তু সময় থেমে থাকে না! বুদ্ধি আর শততার জোরে শত কষ্টের মধ্যেও কারো সাহায্য ছাড়াই শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় সেই মা তার ৪টি ছেলেমেয়ের পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছেন। বড় দুই মেয়েকে গ্রেজুয়েশন করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন ধুমধাম করে। ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ারিং। আর সেই ৩ মাস বয়সী কোলঝাড়া ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে এখন তার সাজানো স্বপ্নের একাকী সংসার!
ক্রমান্বয়ে মেয়ে, বউ আর ”সংগ্রামী মা” এই তিনটিই চরিত্রই আমার জন্মদাত্রীর! মায়ের কষ্টের বোঝা কমাতে প্রথম সন্তান হিসেবে একসময় আমিও সংগ্রামী হয়ে উঠি। পড়াশুনা আর চাকরির কারণে জীবনের অনেকটা সময় মায়ের কাছ থেকে দুরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু যেখানেই থাকি না কেন সবসময় মনটা পড়ে থাকে মা আর ছোট ভাইবোনদের কাছে।
মা দিবসে সবাই অনেক কিছু লেখে। অনেক মা পান সেরা মায়ের পুরস্কার। অল্প শিক্ষিত আমার মা এইসব দিবসের কিছু বুঝেনও না। মা কে যদি বলি আজ ’মা দিবস’ তোমাকে অনেক ভালোবাসি। মা একটা হাসি দিয়ে বলবেন ‘আইচ্ছ যা, কিতা খাইছস আজকে’? এই হলো আমাদের চারটি ভাইবোনের মা। সংগ্রামী এই মাকে ছাড়া আমাদের বড় হয়ে উঠা ছিল অসম্ভব।
জানি মা এই লেখাটা হয়তো পড়বেও না কখনো। তবুও মাকে বলছি ‘ভালোবাসি মা তোমাকে। তোমার সাথে কথা না বলে এখনো আমি আমার দিনের শুরু করতে পারি না। যেখানেই থাকি ছায়ার মতো তুমি থোকো আমাদের পাশে বেঁচে থাকার প্রতিটা দিন।