আমাদের রত্নগর্ভা মা......
॥ নাদিরা কিরণ॥
পুরোনো মফস্বল শহর যশোরে বাবার একক পরিবারের কাঠামো হলেও পরিমন্ডল ছিলো অনেকটা একান্নবর্তী পরিবারের মত। দাদী ছিলেন আমাদের সাথে। ছোট ফুফা আমাদের বাসায় থেকে ডাক্তারি পড়তেন। নানা-নানী মারা যাবার পর অভিভাবকহীন ছোট খালাকে বাবা নিয়ে আসেন। বাবার বয়সে বড় একমাত্র চাচার মেজ ছেলেও হাইস্কুলে পড়তো আমাদের বাসাতে থেকেই । এ সদস্য বাদেই সারা বছরে কদিন অতিথি ছাড়া দুপুর বা রাতের খাবার খেত ঘরের সদস্যরা তা গুনে রাখতে চাইলে বোধহয় কঠিন হতো না। তো সেই পরিবারের এর সমস্ত দায় ছিলো মাত্র ১৬ বছর বয়সে বউ হয়ে আসা যে মেয়েটির কাঁধে তিনি আমার মা। বাড়িতে বাধা কাজের লোক আছে বটে। কিন্তু অতিথি নারায়নদের জন্য দুটো চাল চড়িয়ে দিলে তো হলো না। তায় আবার বাপ-শশুরের বাড়ি বরিশালের ভোজনরসিক খ্যাত এসব মানুষগুলোর আপ্যায়নে চাই পিঠে-পায়েস। ব্যবসা,পরীক্ষার ফলাফল, চিকিৎসা নানা অজুহাতে পাত পাড়া এসব মানুষকে সামলেছে নিজ দায়িত্বে, কৈশোর পেরিয়ে আসা সেই মেয়েটি। রক্তের সম্পর্ক নেই, দিন নেই রাত নেই, এমনকি রাতে ঘুমাতে যাবেন এমন সময়ও একগাল হেসে চলে এলেন কেউ, যেন পরম আত্মীয়ের বাড়ি। তাই বড় হাড়িই চড়তো উনুনে। এখনও অবাক হই ঐ বয়সে এত ধৈর্য শক্তি তিনি পেতেন কেমন করে? বিশেষত বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় সদ্য সাবালক হওয়া বয়সে তাঁর কোল জুড়ে এলাম আমরা দুবোন। জমজ দুটোকে সামলে কি করে এত বড় পরিবারের ভার সামলেছেন তা সত্যি বিস্ময় লাগে। স্ত্রী ও সন্তানের সুস্থতা ও পুষ্টিগুন বজায় রাখতে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বাবার নজরদারী ছিলো ঠিকই। তবে এসব পরিবারে ঘরের বউ পায়ের ওপর পা তুলে বসার সংস্কৃতি তেমন ছিলোনা। ভালো মনের চটপটে মাও হয়ত সে কথা ভাবতেও পারতেন না। কেবল রান্নায় পাকা এটুকুতেই মায়ের গুনিপনার সমাপ্তি টানা যাবেনা। কারুশৈলীতেও ছিলেন দারুণ পারদর্শী। তার হাতে সোয়েটার কেবল বাবা ও আমরা পরিনি, আত্মীয় এমনকি আশেপাশের অনেকের আবদারও মিটিয়েছেন। ঘরের এত কাজের ফাঁকে ক্রুশ কাটায় সুক্ষ ডিজাইনে কাপড়ের জমিন ছাড়াই বেডকভার, টেবিল ম্যাট, টিভি কাভার করতেন যার প্রশংসা ছিলো লোক মুখে। এমনকি ক্রুশকাটায় বোনা মাথার টুপি কত জনকে যে বানিয়ে দিয়েছেন মায়ের নিজেরও হয়ত মনে নেই। বিছানার চাদরে এপলিক ও হাতের বুননের এসব কিছু আজও রেখেছি স্মৃতি হিসেবে।
এযুগের হলে সে আমলে থাকলে একটা স্কুল খুলে ট্রেনিং সেন্টার বা শপ কিছু একটা করতে পারতেন দিব্যি। এত কিছুর বাদেও মেয়েদের পড়াশুনা দেখভালের প্রায় পুরো কৃতিত্বই দিতে হবে তাঁকে। টিউশন ফি, টিউটর, স্কুল ড্রেস এগুলোর অর্থের জোগান বাবা মিটিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু প্রথম হাতে খড়ি, পড়তে বসানো, ঘরে কোন টিচারটি ভালো হবে এসব করেছেন মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ুয়া মা। আমাদের পরীক্ষার আগে রাত জাগতেন তিনি। ঘুম তাড়াতে ফ্লাক্সে চা বানিয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে এসে ঘুরে দেখে যেতেন জেগে আছি কিনা। স্কুল জীবনে আমরা চারটি বোনই যে সুনামের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি তার পেছনের বেশিরভাগ কৃতিত্বটুকু এই মায়ের। সেজন্য স্কুলে শিক্ষক এমনকি অন্য বন্ধুদের মায়েরাও বেশ সুনাম করতেন বেশ মনে আছে বাকি বোনদের বেলায় তাঁর একই রকম সম্মান পাওয়ায়। যেকোন সন্তানের কাছে তার মা অতুলনীয়। আমার কাছেও তাই। বিশেষ করে মায়ের যে গুনগুলো তাকে পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে তা সন্তান হিসেবে আলাদা পরিতৃপ্ত করে বৈকি। কন্যা হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আধুনিক মনের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ঋণ অসীম। তবে আজ চারটি বোনই যতটা প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মান যেটুকু পাই তার পেছনের মুল যোদ্ধা এই আমার মা। এমনকি আমার সন্তানের প্রকৃত অভিভাবকও তিনি। জীবনের নানা টানাপোড়েনে আমার মাথায় তার হাতটি কেবল রেখেছেন তাই নয়। দৌহিত্রের দেখভাল, তার মানসিক গঠনটিও তৈরি করেছেন পরম মমতায়। তাই নিশ্চিন্তে সাংবাদিকতার মত চ্যালেঞ্জিং পেশায় এখনও টিকে আছি। সন্তানটিও বেড়ে উঠছে স্বাভাবিক সুস্থ্যতায়। উচ্চাশা মানুষকে নষ্ট করে, সীমিত কিন্তু পরিশ্রমের অর্জন মানুষকে তৃপ্ত করে এবং সম্মানিত করে এগুলো শিখেছি বাবা- মা দুজনের কাছেই। তবে নিজের নানা সরল বোকামিতে ভেঙে পড়লে যে আশ্রয়টুকু আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটা জুগিয়েছে সে একান্তই মা। মা-ই শিখিয়েছেন, একমাত্র ছেলেকে যেন চাইবা মাত্র চাহিদা পুরণ করে উচ্চাভিলাষী না করি। যেন পরিশ্রমের অর্জন হিসেব করে খরচ করার শিক্ষাটা দেই ছোটকাল থেকেই। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল আর্থিক গত দিক দিয়ে আমি নিয়েছিলাম ঠিকই। তবে বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো মা যেভাবে সামলেছেল, আমাদের বোনদের আগলেছেন তা দু/চার কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চার কন্যার বিধবা নারীকে কতটা পঙ্কিলতায় পড়তে হয় আত্মীয় ও প্রতিবেশীর কুটচালে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। ছেলে নেই তাই চাচাতো ভাইদের ছোবল, গ্রামে পৈত্রিক জমি তো বটেই, বাবার কেনা জমি এমনকি শহরের বাড়িটিতেও যেন ভাগিদারের হানা। জীবিত অবস্থায় বাবাকে অনেক বুঝিয়ে আমাদের নামে তা লিখিয়ে না নিলে আজ হয়তো মাথার ছাদটিও পড়তো অনিশ্চয়তায়। অন্তত মামলা- মোকাদ্দমার গ্যাড়াকলে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি দশা হতো তা স্বজনদের সে সময়ের তোড়জোড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আর বাসার সাথে লাগোয়া জমির সীমানায় প্রতিবেশীদের অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা যেভাবে আমরা সামলেছি তার বেশী কৃতিত্বটাই মায়ের। রাতের অন্ধকারে জমির সীমানা প্রাচীর বা দেয়াল ফেলে দেয়া, রাজউকের লোক ডেকে হুমকি, ঘুষ দাবি, প্রতিবেশীর জন্য রাস্তা ছেড়ে দেবার জন্য রাজনৈতিক নেতা দিয়ে দেন-দরবার, নিজের সীমানা নির্ধারনেও শালিসি বৈঠক কিনা সামলাতে হয়েছে বাবার মৃত্যুর পর। প্রশাসনিক দৌড়টা আমি দৌড়ালেও সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থান থেকে এসব নেতাদের শালিসি বৈঠক মা সামলেছেন যে বুদ্ধিমত্ত্বায় তা এ যুগের অনেক উচ্চ শিক্ষিতেরাও অবাক হবেন বোধকরি। বাড়িটা দোতলা অবদি পুরোটা না করেই বাবা মারা যান। তাঁর ব্যবসায়ের অংশীদারিত্ব বা পাওনা টাকাও লিখিত দলিল-দস্তাবেজ না থাকায় বুঝে পাইনি। তবুও ভেঙে পড়েননি মা। অফিস বাইরের টুকু আমি সামলেছি আর হিসেবের সুদক্ষ বিবেচনায় মা সামলেছেন দুবোনের পড়াশুনাসহ সংসারের যাবতীয় ঝামেলা।
ইট-সুরকি, বালু কিনে নিজে দাড়িয়ে থেকে রাজমিস্ত্রি, জোগালে সামলে বাবার অসমাপ্ত দোতলার ওপর তুলে দিয়েছেন আরও দুটি ফ্লোর। মেয়েদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা গড়ে দিয়েছেন নিশ্চিত আবাসন। পেশার দায়িত্ব সামলে যা করা আমাদের জন্য ছিলো দুঃসাধ্য। এই আমার মা, যিনি আজও আমাদের আগলে রেখেছেন। আমার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। পড়াশুনার পাশাপাশি অনেক কারুশৈলীও শিখিয়েছেন আমাদের। উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেয়েও সুশিক্ষিত আমার মা কে কেবল গৃহিণীর তকমায় ফেললে অমর্যাদা করা হবে। এখনও অবসরহীন মা কাজের ফাঁকে নিয়ম করে পেপার পড়েন, টিভির খবরাখবরও দেখেন নিয়মিত। সেই ছোট্ট বেলায় বেগম পত্রিকার সাথে পরিচয় ঘটে মায়ের পড়ার জন্য বাড়িতে আসতো বলেই। গল্পের বই পড়ার নেশাটিও হয়েছে মায়ের সংগ্রহ থেকেই। ঈদের বিশেষ সংখ্যার গল্প আজও মায়ের সঙ্গী। মনের জোরে, নানা ঝক্কি আর ত্যাগ স্বীকার করে একাধারে সংসার সামলে ও চারটি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠা করেছেন যে মা। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত না মিললেও আমাদের কাছে তিনি রত্নগর্ভা মা।
লেখক: নাদিরা কিরণ
নিউজ এডিটর, এটিএন বাংলা