ভালোবাসার অন্ধকারে জীবনের ইতি
নাম অ্যালেক্স বেরেভো দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। দেখলে মনেই হবে না যে তার জন্ম মেক্সিকোতে। বরং ইউরোপের স্প্যানিশদের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে। বড় হয়েছে কিন্তু তেমন কিছু করে না। বলতে গেলে বোন- দুলাভাইয়ের সাগর পাড়ের হোটেল আর রেস্টুরেন্টেই তার আড্ডা। তিজুয়ানা, মেক্সিকোর ছোট্ট এই শহর, আমেরিকার সান ডিয়েগোর থেকে খুবই কাছে। ছুটি কাঁটাতে বিশ্বের অনেক দেশের ছেলে-মেয়েদের আনাগোনা এখানে।
অ্যালেক্সের দিনকাল বেশ ভালোই চলছে নতুন নতুন বান্ধবী নিয়ে সাগর পাড়ে। সারা দিন নিত্য নতুন বান্ধবী এবং তাদের সঙ্গে ইনটিমেট মেলামেশা করে তার সময় পার হচ্ছে। তার অনেক টেম্পোরারি বান্ধবী। ছুটিতে অনেক সময় এমন সব ঘটনা ঘটে থাকে বলতে গেলে বিশ্বের নানা জায়গায়। যেমন স্বল্প সময়ের দেখাই হয়তবা হয়ে গেল প্রেম প্রীতি বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যা অ্যালেক্সের জীবনে ঘটে চলেছে বহুদিন ধরে।
হঠাৎ আজ সাত সকালে অ্যালেক্সের রুমের দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। এদিকে অ্যালেক্সের রুমে নতুন বান্ধবী। কী করা? শেষে আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে বেরতেই দেখে এক সুন্দরী রমণী। কোলে তার ৩-৪ মাসের এক মেয়ে। কিছুক্ষণ কথা চলতেই বুঝতে সমস্যা হলো না। এক বছরের বেশি হবে আমেরিকার লস এঞ্জেলসের এই মেয়ে নাম ভালেন্টিনা এসেছিল বেড়াতে তিজুয়ানা, মেক্সিকোতে।
সামান্য পরিচয়ে হয়েছিল ভালেন্টিনা অ্যালেক্সের সঙ্গিনী। ইনটিমেট মেলামেশার পর সম্পর্কের ইতি ঘটে তখন কোন এক সময়। শেষে ভালেন্টিনা হারিয়ে যায় অ্যালেক্সের জীবন থেকে। যাইহোক আজ হঠাৎ তাদের দেখা মেলে সাত সকালে। ভালেন্টিনা এসেছিল অ্যালেক্সের সঙ্গে হয়ত কথা বলতে তার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে। রুমের ভেতরে নতুন আরেক রমণীকে দেখে ভালেন্টিনা তার মত পাল্টে ফেলে।
হঠাৎ মেয়েটিকে অ্যালেক্সের কোলের ওপর দিয়ে বললো, দশটি ডলার হবে? ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দিতে হবে। অ্যালেক্স তাকে দশ ডলার দিতেই ভালেন্টিনা চলে গেলো। বেশ সময় পার হয়ে গেলো অথচ ভালেন্টিনার কোন খোঁজ নেই। ঘণ্টা খানেক যেতে হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল।
হ্যালো ভালেন্টিনা বলছি, মেয়েকে তোমার দায়িত্বে রেখে গেলাম। ও তোমারও মেয়ে, ওকে যত্ন করে গড়ে তুলো। গুডবাই! টেলিফোন ছেড়ে দিল অথচ রিসিভার ঠিকমত রাখা হয়নি। টেলিফোনের ওপাশ থেকে তাই অ্যালেক্স শুনছে, লাস্ট কল টু লস এঞ্জেলস ফ্লাইট। অ্যালেক্স তাড়াহুড়ো করে মেয়েটিকে নিয়ে তিজুয়ানা বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই প্লেন ছেড়ে দিল।
অ্যালেক্স মেয়েটিকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসে দেখে মেয়েটির ছোট্ট একটি ব্যাগের মধ্যে রয়েছে তার পাসপোর্ট। নাম ভিক্টোরিয়া ভালেন্টিনা। অ্যালেক্সের রোমান্টিক জীবনের মোড় ঘুরে গেল। কে সেই ভালেন্টিনা? কোথাই পাব তার ঠিকানা আর কেনই বা সে ভিক্টরিয়াকে আমার কাছে ফেলে চলে গেল! হাজারও প্রশ্ন এখন তার মাথায়। অ্যালেক্সের জীবনের রোমান্টিক সময়ের অবসান ঘটতে শুরু হলো। নতুন জীবন শুরু হলো ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে। তার ডায়াপার পাল্টানো থেকে শুরু করে ফিডিং সবই এখন অ্যালেক্সকে সামলাতে হচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার চেহারার সঙ্গে অ্যালেক্সের তেমন মিল নেই, তবে সময়ের সঙ্গে ওদের দুজনের মনের মিল হতে চলেছে বেশ গাঢ়। মাস দুই যেতেই হঠাৎ ভালেন্টিনার চিঠি এসেছে আমেরিকা থেকে।
চিঠিতে ঠিকানা দেয়নি তবে তার একটি ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটি তোলা হয়েছে হলিউডের ফিল্ম স্টুডিওর ভেতর থেকে। অ্যালেক্সের মাথায় চিন্তা ঢুকেছে, তার ধারনা ভালেন্টিনা সেখানে ফিটনেসের ওপর কাজ করে। এদিকে ছয় সাত মাস পার হয়েছে, শেষে অ্যালেক্স প্লান করে লস অ্যাঞ্জেলসের হলিউডে আসার ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে।
পথে নানা ঝামেলা পেরিয়ে হলিউডে এসে ভালেন্টিনার ছবি অনেককেই দেখাতে থাকে। শেষে একজন বলে, সম্ভবত ভালেন্টিনাকে মাস খানেক আগে দেখেছি হলিউডের হোটেলে। চলে গেল হোটেলে। মেয়েটিকে হোটেলের সুইমিং পুলের পাশে রেখে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে অ্যালেক্স বহু তলা বিশিষ্ট হোটেলের উপর এসেছে।
ম্যানেজার ভালেন্টিনার ছবি দেখে চিনতে পারে। তবে জানিয়ে দিল ভালেন্টিনা কিছু দিন আগে চাকরি ছেড়ে নিউইয়র্কে মুভ করেছে। অ্যালেক্স এ কথা শুনে বেলুনের মত চুপসে গেলো। বাইরে চোখ ফেলতেই দেখে ভিক্টোরিয়া হামাগুড়ি দিয়ে সুইমিং পুলের দিকে যাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই, কী করা! ভিক্টোরিয়া সুইমিং পুলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। অ্যালেক্স ওপর থেকে লাফ মেরে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ভিক্টোরিয়ার জীবন বাঁচাতে।
ঘটনার সাক্ষী সেই ম্যানেজার এবং হোটেলের ক্যামেরায় ধরা পড়ে গেল এমন একটি বিস্ময়কর ঘটনা। অ্যালেক্সের ভাগ্য খুলে গেলো। সে হলিউডের সিনেমায় স্টান্টমানের অভিনয়ে সুযোগ পেল। অ্যালেক্স ভাবছে, এমন সুযোগ জীবনে নাও আসতে পারে, তার পর মেয়ে ভিক্টোরিয়ার ভবিষ্যত, সব ভেবে রাজি হয়ে গেলো। অ্যালেক্সের কর্মহীন জীবনের এক নতুন যাত্রা আমেরিকার হলিউডে শুরু হলো।
আমেরিকার খ্যাতনামা বিশ্বতারকার পাতায় অ্যালেক্সের নাম আর ছবি ধরা পড়ে ভালেন্টিনার চোখে। এদিকে ভিক্টোরিয়া বাবার আদরে বড় হতে চলেছে। সে এখন স্কুলে যায়। পারেন্টসদের দায়িত্বে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা আসা যাওয়া করে। অথচ ভিক্টোরিয়া শুধু তার বাবার সঙ্গে স্কুলে যায় আবার বাড়িতে আসে। কোথাও সে তার মাকে দেখে না।
মায়ের কথা বলতেই বাবা যেন কেমন দিশাহারা হয়ে পড়ে যা ভিক্টোরিয়ার চোখে ধরা পড়েছে। অ্যালেক্স ভালেন্টিনার হয়ে ভিক্টোরিয়াকে চিঠি লিখে, নানা অজুহাত দিয়ে বর্ণনা করে, কেন মা তাকে এত বছর হয়ে গেল অথচ দেখতে আসেনি। চলছে বাবা এবং মেয়ের মাঝে মান অভিমান, অপেক্ষা আর প্রতীক্ষার পালা।
ঠিক তেমন একটি মুহূর্তে অ্যালেক্স জানতে পেরেছে ভিক্টোরিয়ার মারাত্মক অসুখ করেছে। সে মারা যাবে তার বয়স টিন এজে আসতেই। ডাক্তার এও বলেছে যদি ভিক্টোরিয়া বড় আকারে মানসিক আঘাত পায় তাহলে তার অকাল মৃত্যু হবার সম্ভাবনা আরও বেশি। এমন একটি মর্মান্তিক খবরে অ্যালেক্স ভেঙ্গে পড়েছে বটে তবে তা টের পেতে দেয়নি সে তার ভিক্টোরিয়াকে।
মেয়ের জীবনের সব আশা পূরণ করতে অ্যালেক্স তার জীবন দিতে প্রস্তুত। তাই সে ভিক্টোরিয়ার জীবনের শেষ সময়গুলো যেন আনন্দময় হয় তার জন্য সব চেষ্টা করে চলেছে। এমন সময় হঠাৎ বিনা নোটিসে ভালেল্টিনা এসে হাজির হলিউডে। ভালেন্টিনার আগমনে সত্যিই ভিক্টোরিয়া মুগ্ধ। সে মাকে তার কল্পনায় খুব উঁচু আসনে বসিয়েছে। সবই সম্ভব হয়েছে বাবার কারণে।
বাবা কখনও ভিক্টোরিয়ার কাছে ভালেন্টিনাকে ছোট করে কিছু বলেনি কোনদিন। ভালেন্টিনা মনের আনন্দে মিলেমিশে চলছে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে। কয়েকদিন এক সঙ্গে থাকার পর ভালেন্টিনা বলে গেল সত্বর সে বেড়াতে আসবে, তবে সঙ্গে নিয়ে আসবে তার নতুন জীবন সঙ্গীকে। শুনে ভিক্টোরিয়া একটু ভেঙ্গে পড়ে, তবে অ্যালেক্স তাকে বিষয়টি নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে।
সময় চলছে তার মত করে, হঠাৎ একদিন কোর্ট থেকে নোটিস এসেছে অ্যালেক্সের কাছে। কী ব্যাপার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। কোর্টে গিয়ে দেখে ভালেন্টিনা তার লেজবিয়ান সঙ্গীকে নিয়ে অপেক্ষা করছে। উদ্দেশ্য ভিক্টোরিয়াকে অ্যালেক্সের জীবন থেকে সরিয়ে নেওয়া।
সাতটি বছর বাবা-মেয়ে কঠিন সংগ্রাম করে ভালোবাসার স্বপ্নের জাল বুনেছে, সঙ্গে বুকভরা ভালোবাসা মাকে পাবার অপেক্ষা অথচ এ কেমন অবিচার! আজ এ কী হতে চলেছে? ভালেন্টিনা ক্লেইম করেছে অ্যালেক্স ভিক্টোরিয়ার বায়োলজিক্যাল বাবা নয়। অ্যালেক্স আকাশ থেকে পড়েছে শুনে, এদিকে ভিক্টোরিয়া জানতে পেরেছে তাকে তার মা তার বাবার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে নিতে এসেছে। মূলত লেজবিয়ান সঙ্গী, যে নতুন করে ভালেন্টিনার জীবনে এসেছে সে সহ্য করতে পারেনি অ্যালেক্স এবং ভিক্টোরিয়াকে তাদের জীবনে। তাই সে এমনটি অমানবিক হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে বিচ্ছেদ ঘটাতে। সব শেষে কোর্টের সিদ্ধান্তের পর এসেছে ভালেন্টিনা ভিক্টোরিয়াকে নিতে।
কয়েকদিন সময় লাগবে সব কিছু যোগাড় করতে। ভিক্টোরিয়া সকালে স্কুল গিয়ে তার এক প্রিয় শিক্ষককে সব বিষয় বলে। শেষে সে স্কুল থেকে পালিয়ে তার সেই শিক্ষকের সাহায্যে চলে যায় তিজুয়ানা, মেক্সিকোতে। যেখানে অ্যালেক্সের বোন ও দুলাভাই থাকে। শিক্ষক আমেরিকায় ফিরে এসে অ্যালেক্সকে বিষয়টি খুলে বলে। খবর পেয়ে অ্যালেক্স ফিরে আসে তার মেয়ের কাছে।
ভালেন্টিনার বড়লোক লেজবিয়ান সঙ্গী পুলিশের সাহায্য নিয়ে তদন্ত করে সব জানতে পারে যে স্কুল শিক্ষক ভিক্টোরিয়াকে সরিয়েছে। বিচারের কাঠগড়ায় আমেরিকান শিশু পাচার করার অপরাধে শিক্ষকের শাস্তি হবার কিছুক্ষণ আগে বিচারক কিউরিয়াস হয়ে বিষয়টি জানতে চান কেন সে এমন কাজটি করেছে। শিক্ষক কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আর বলতে থাকে কীভাবে অ্যালেক্স সাতটি বছর ভিক্টোরিয়াকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, মেয়েটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলেছে।
এদিকে অ্যালেক্স তার নিজের শরীরের রক্তের বিনিময়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তার ভিক্টোরিয়াকে। ভিক্টোরিয়া এ খবর জানতে পারলে সে তার জীবন হারাবে। যা সে একজন শিক্ষক হয়ে মেনে নিতে পারিনি তাই তাকে সরিয়েছে। সে ভিক্টোরিয়া এবং অ্যালেক্সের বিচ্ছিন্নতাকে মেনে নিতে পারিনি, তাইতো সে ভিক্টোরিয়াকে মেক্সিকোতে রেখে এসেছে।
পুরো ঘটনা ভালেন্টিনা শোনার পর সে তার কেস তুলে নেয় এবং লেজবিয়ান সঙ্গীকে ফেলে সেও ফিরে আসে তার অসুস্থ মেয়ের কাছে মেক্সিকোতে। তিজুয়ানা সাগরের পাড়ে ভালেন্টিনা এসে পৌঁছেছে বটে, তবে দেখা মেলেনি তার মেয়ের সঙ্গে। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়ে ভিক্টোরিয়ার জীবনের ইতি ঘটে ভালোবাসার অন্ধকারে।
লেখক: সুইডেন প্রবাসী
[email protected]