শিরোনাম
সব প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ: প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপে তৎপর ভারতীয় আমেরিকানরা টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা সাকিবের প্রথমবারের মতো ইউক্রেনে রাশিয়ার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় ভারতীয় সেনা নিহত সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর গাজায় ১০০ ট্রাক ত্রাণ লুট করে নিল মুখোশ পরিহিতরা নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 24 February, 2018 02:02

গণভবনে এক অনন্য সন্ধ্যা


গণভবনে এক অনন্য সন্ধ্যা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাড়ি গণভবন চেনেন না, তেমন মানুষ বাংলাদেশে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি বিশ্বখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই কানের জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সে নকশায় অন্তর্ভুক্ত। শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত কয়েক একর জমির ওপর নির্মিত লাল ইটের এই সুরম্য দৃষ্টিনন্দন দালানটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই ভবনটি তিনি প্রথম ব্যবহার শুরু করেন তার দফতর হিসেবে। প্রস্তাব হয়েছিল, তিনি যেন তার পরিবারসহ বাড়িটিতে উঠে আসেন। কিন্তু বেগম মুজিব ধানমন্ডির বাড়ি ছাড়তে রাজি হননি। কারণ, ওই বাড়ীর পেছনে তার অনেক পরিশ্রম আর স্মৃতি আছে। বঙ্গবন্ধুরও তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। অনেকের মতে, বঙ্গবন্ধু যদি ওই বাড়িতে থাকতেন, তাহলে হয়তো ১৫ আগস্টের ঘাতকরা এত সহজে তাকে সপরিবারে হত্যা করতে পারত না।
বর্তমানে গণভবনের বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি সেনানিবাসের বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করতেন। গণভবন ছিল অবহেলিত। যদিও এই বাড়িতে বিভিন্ন কাজে অনেকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সেখানে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে অবিস্থত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোনালিসা দাসকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। ড. দাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৬ সালে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাদের প্রথম সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে। আমার জন্য তা নিঃসন্দেহে সম্মানের। যাওয়ার আগে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে এক সাক্ষাতে তাকে খবরটা দিলে তিনি বেশ খুশি হলেন। বললেন, আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। তিনি আসানসোল গিয়েছিলেন জাতীয় কবি নজরুলের জন্ম ভিটায়, ১৯৯৭ সালে। তখন এলাকাটি বেশ অনুন্নত ছিল। তার আগমন উপলক্ষে সেখানে পাকা রাস্তা আর হেলিপ্যাড হলো। আসানসোল গিয়ে বুঝলাম সেখানকার মানুষ শেখ হাসিনাকে ভুলেননি।
কলকাতা থেকে অসানসোল— সড়ক পথে প্রায় চার ঘণ্টার পথ। সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে কলকাতায় গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে সোজা আসানসোল। রেলের গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা। অনুষ্ঠানের দিন সকালে রেলের গেস্ট হাউসে দেখি এক স্মার্ট চটপটে সুন্দরী নারী আমাকে খুঁজছেন। পরিচয় দিতেই বললেন, তিনি মোনালিসা দাস। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান। আমাকে সমাবর্তনে নিতে এসেছেন। প্রথম আলাপেই ছটফটে স্বভাব আর আন্তরিকতার জন্য বেশ ভালো লেগে গেল ভদ্রমহিলাকে। পুরো সমাবর্তন মনে হচ্ছে তিনি একাই সামাল দিচ্ছেন।
মোনালিসা জানালেন, তার পূর্বপ্রজন্মের শিকড় প্রোথিত বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। ওপার বাংলার অনেকের মতো মোনালিসার পূর্বপুরুষ দেশ ভাগের বলি। গত দু’বছর দেখেছি, নিয়মিত তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে অংশ নিতে আসেন। এলে দেখা করার চেষ্টা করেন। গত বছর থেকে একুশের বইমেলায় আসা শুরু করেছেন। নিজে লেখালেখি করেন। গবেষণায় আগ্রহ আছে প্রচুর। সদ্যসমাপ্ত কলকাতা বইমেলায় ড. মোনালিসা দাস সংকলিত ও সম্পাদিত নতুন বই ‘আলোক সম্পাতে নজরুল’ প্রকাশিত হয়েছে। এবার ১৭ তারিখ ঢাকায় এসছেন। ১৯ তারিখ ড. মোনালিসার ফোন। জানালেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডিলিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠি তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিতে চান। ২৬ তারিখ দেশে ফিরে যাবেন। তাকে একটু সাহায্য করতে হবে। এত অল্প সময়ে তা কীভাবে সম্ভব, বুঝে উঠতে পারি না। ‘দেখি কী করা যায়’ ছাড়া আর কোনও আশার বাণী শোনাতে পারলাম না ড. মোনালিসাকে।
২০ ফেব্রুয়ারি ওসমানি মিলনায়তনে একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান শেষে আপ্যায়নের সময় প্রধানমন্ত্রীকে খবরটা দিলাম। তিনি বেশ খুশি হলেন। বললাম, সন্ধ্যায় ড. মোনালিসা দাসকে নিয়ে গণভবনে আসব। অন্য একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমার এমনিতেই গণভবনে যাওয়ার কথা। তিনি সম্মতি দিলেন। সঙ্গে ড. দাসকে নিয়ে আসতে গেলে তার জন্য পাস লাগবে। এত অল্প সময়ে পাস জোগাড় করা একটু কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মো. সাইফুজ্জামানকে (শেখর) ফোন করলে তিনি পাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। শেখরের কাছে কোনও বিষয়ে সহায়তা চাইলে কখনও তিনি না করেন না। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় ড. মোনালিসাকে নিয়ে গণভবনে যখন ঢুকি, তখনও গণভবনের ভেতরের গাছগুলোতে হাজার হাজার পাখির কলরব। ভেতরে ঢুকতেই দেখি বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী অপেক্ষা করছেন। এই দৃশ্য নিত্যদিনের। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী এক সভায় বলেছিলেন, গণভবনের দ্বার সবার জন্য অবারিত। এটি জনগণের ভবন। ভেতরে ঢুকলে বুঝা যায়, সত্যেই গণভবন জনগণের ভবন। ভেতরে একজন জনগণের নেতা থাকেন।
সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ভারত থেকে বাংলাদেশে একটি আন্তঃদেশীয় কনফারেন্সে আসা ২৩ জন সাংবাদিক গণভবনের পশ্চিম দিকের একটি বড় কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসন নিয়েছেন। যে সংগঠনটির আমন্ত্রণে তাদের বাংলাদেশে আসা, তার সঙ্গে আমারও সম্পৃক্ততা আছে। ড. মোনালিসার সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলে আমারও সেখানে যাওয়ার কথা।
সোয়া ৬টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী ওপর তলা থেকে নামলেন। এরই মধ্যে দলীয় বেশকিছু নেতাকর্মী নিচের লাউঞ্জে জড়ো হয়েছেন। কেউ এসেছেন মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে, কেউ স্রেফ প্রিয় নেত্রীকে সালাম করতে। প্রবাসী দুয়েকজনকেও দেখা গেলো। তিনি তাদের সঙ্গে প্রায় ২০ মিনিট কথা বলে আমার কাছে আসতেই প্রথমে তার হাতে আমার ইংরেজিতে লেখা নতুন বই ‘ন্যাশন পিপল এ পলিটিক্স’ তুলে দিলাম। তিনি বললেন, বিদেশিদের সুবিধার্থে ইংরেজিতে আরও বেশি বই লেখা উচিত।
এরপর পরিচয় করিয়ে দেই ড. মোনালিসা দাসকে। তার বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য আগেই প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। ড. মোনালিসা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের চিঠি ও আমন্ত্রণপত্র তুলে দিলেন। বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ড. দাসের দু’টি প্রত্যাশা আছে— তাকে প্রণম করা আর তার সাথে একটা ছবি তোলা। প্রধানমন্ত্রী উত্তরে একটু হাসি দিয়ে ফটোগ্রাফারকে আসতে বললেন। এরই মধ্যে ড. মোনালিসা প্রধানমন্ত্রীকে প্রণাম করে ফেলেছেন। তিনি মাথায় হাত রেখে ড. দাসকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর একটা পোর্ট্রেটের নিচে। কয়েকটি ছবি তোলার পর হঠাৎ তিনি আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললেন, ‘আমাকে যে বই দিলেন, তার ছবি তুলবেন না?’ আমি তো শুধু আবাকই নই, অভিভূতও। প্রধানমন্ত্রীর এডিসি’র হাত থেকে বইটি নিয়ে তার পাশে দাঁড়াই। এবার দু’জনের ক্যামরায় ছবি ওঠে। শেখ হাসিনার অনেক আচরণ দেখে বুঝার উপায় নেই তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা আর দেশের প্রধানমন্ত্রী। তার আচরণে মনে হয়, তিনি বড় বোন, ফুফু বা খালা। এই সব করতে করতে রাত প্রায় ৭টা। তখন তিনি ভারত থেকে আসা অপেক্ষমাণ সংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চলে গেলেন। তার আগে আমরাও সেই কক্ষে আসন নিয়েছি।
এটা কোনও সাংবাদিক সম্মেলন ছিল না। পরিচয় পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। তিস্তায় পানিবণ্টন চুক্তি থেকে শুরু করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা আর আসন্ন নির্বাচন— কিছুই বাদ গেলো না। টানা দেড় ঘণ্টা। তারপর আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন। এই পর্ব শেষ না হতেই শুরু হলো অতিথি সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প আর সেলফি তোলার ধুম। এক সাংবাদিক তার এক সহকর্মীর কাছে মন্তব্য করলেন, ‘আজ শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হলো না, একজন জনমানুষের নেতার সঙ্গে পরিচয় হলো।’ আমি তাদের বলি, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি যেকোনও সময় সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে যেতে পারেন।’
গণভবন থেকে যখন গাড়িতে চড়ে ফিরছিলাম, ড. মোনালিসা মন্তব্য করলেন, ‘আজকের সন্ধ্যাটা মনে থাকবে বহুদিন। তিনি (শেখ হাসিনা) যখন আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন, তখন মনে হলো— বিশ্বের সব শান্তি আমাকে ছুঁয়ে গেলো।’

 

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

উপরে