শিরোনাম
আগে চারজন দাঁড়াত, এখন একটা মারলে ৪০ জন দাঁড়াবে: ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে বন্দুক হামলায় নিহত ৩ গিনিতে ফুটবল ম্যাচে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় ১০০ নিহত রাশিয়ার ‘হাইব্রিড আক্রমণ’ নিয়ে সতর্কতা জার্মানির ভারতে মসজিদে ‘সমীক্ষা’ চালানো ঘিরে সংঘর্ষ, নিহত ৩ সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ব্রাজিলে বাস দুর্ঘটনায় ৩৮ জনের মৃত্যু নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 13 April, 2018 02:29

রাজাকার আলবদরের সন্তানদের জন্যে আইন করতে হবে

রাজাকার আলবদরের সন্তানদের জন্যে আইন করতে হবে
স্বদেশ রায় :

শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আতাউস সামাদ সাংবাদিকতায় আমার গুরু ছিলেন। একটা বয়সে এসে গুরু শিষ্যের ভেতর অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়। সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেশের নানান বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা আলোচনা হতো। প্রায় এ আলোচনাগুলো হতো গভীর রাতে টেলিফোনে। ২০০১-এর বিএনপি- জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে ওই সরকারের সম্পর্ক খারাপ ছিল না।  ছেলের ব্যবসা ও নিজে একটি টেলিভিশনের লাইসেন্স নেওয়ার জন্যে তাকে প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে শুধু নয়, বেগম জিয়ার সঙ্গে বেশ কথাবার্তা বলতে হয়। এসব কথাবার্তায় সামাদ ভাই ঠিক হতাশ নন, রিপোর্টার হিসেবে নতুন একটা জগতের সন্ধান পান। ওই সময়ের বেগম জিয়ার মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী, যিনি সম্পর্কে সামাদ ভাইয়ের আত্মীয়। কামাল সিদ্দিকী নিজেও কয়েকবার সামাদ ভাইয়ের টেলিভিশনের লাইসেন্সটির জন্যে চেষ্টা করেন। এর পরে কামাল সিদ্দিকী একদিন তাকে বলেন, আপনি আর এই লাইসেন্সের জন্যে চেষ্টা করেন না। মুসা সাহেবেরটা হয়তো দিলেও দিতে পারে কিন্তু আপনার টেলিভিশনের লাইসেন্স এই সরকার দেবে না। কারণ, বেগম জিয়া একটি ক্ষেত্রে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি মনে করছেন, আপনাকে টেলিভিশন দিলে শেষ অবধি সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের টেলিভিশন হয়ে যাবে। কারণ, আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে নির্মোহভাবে সত্য কথা লেখেন। তাছাড়া শেখ সাহেবের সম্পর্কে আপনার ধারণা অনেক উচ্চ। ওই দিন বেশ গভীর রাতে সামাদ ভাই আমাকে ফোন করে বললেন, স্বদেশ তুমি কী মনে করো কামাল সিদ্দিকী যা বলছে তা  ঠিক? আমি তাঁকে বলি, দেখেন, আপনার সঙ্গে ও মুসা ভাইয়ের সঙ্গে বেগম জিয়ার সম্পর্ক অনেক ভালো। তাই আপনি এটা ভালো বুঝবেন। তবে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে মুসা ভাইকে দেবেন কিনা জানি না তবে আপনাকে টেলিভিশনের লাইসেন্স দেবেন বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, কেন তোমার এটা মনে হয়। আমি বলি, আপনি নিজে ঢাকার গেরিলাদের গাড়ি ড্রাইভ করে অপারেশনে সাহায্য করেছেন। আপনার ভাইপো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। তাই শেখ হাসিনা নিশ্চিন্তে আপনাকে বিশ্বাস করবেন। তখন সামাদ ভাই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললেন,আগরতলা মামলার সময় শেখ সাহেব কিন্তু মওলানা সাহেবকে খবর পাঠিয়েছিলেন আমাকে দিয়ে। নাম বলবো না, তবে আরো দু’জন সাংবাদিক ছিল, তিনি তাদের বিশ্বাস করেননি। আমি হেসে বলি, এ জন্যে তো শেখ হাসিনা আপনাকে টেলিভিশনের লাইসেন্স দেবেন।

হঠাৎ করে সামাদ ভাইয়ের গলা গম্ভীর হয়ে যায়। তিনি বলেন, স্বদেশ, আমাকে বিএনপি- জামায়াত সরকার টেলিভিশন দিক বা না দিক সেটা বড় কথা নয়। তবে স্বাধীনতার পর থেকে এ অবধি একজন রিপোর্টার হিসেবে প্রশাসনে কম ঘুরিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশের প্রশাসনে যতদিন মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা না আসবে, ততদিন বাংলাদেশ প্রকৃত বাংলাদেশ হবে না। নিজামী মন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের কী ক্ষতি করে যাচ্ছে তা বোঝা যাবে কয়েক বছর পরে। তার মন্ত্রণালয় সে রাজাকার, আলবদরের ছেলেদের দিয়ে ভরে ফেলেছে। সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল অনেক বেশি গভীর। তাই কোনও দ্বিধা না করে তাকে বলি, সামাদ ভাই আপনি কোনও ক্ষোভ থেকে এ কথা বলছেন না সত্য সত্যই আপনার অভিজ্ঞতা আমার মাঝে সঞ্ঝারিত করার জন্যে  বলছেন। সামাদ ভাই আবার তার দিলখোলা হাসি দিয়ে বললেন, স্বদেশ আপনি (সামাদ ভাই খুব সিরিয়াস হয়ে গেলে তখন সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন) অন্তত আমাকে চেনেন। একটা সামান্য টেলিভিশনের লাইসেন্সের জন্যে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে কোনও কথা বলবো! তবে হ্যাঁ, এই ঘটনার ভেতর দিয়ে আমার বেগম জিয়ার মানসিকতার আরেকটা দিক চেনা হলো। আমি বুঝতে পারি সামাদ ভাই এখন সিরিয়াস। তাই তাকে সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি মনে করেন প্রশাসনে শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ থাকা দরকার। তিনি তখন আরও সিরিয়াস হয়ে বলেন, এছাড়া কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না।

এই লেখা লিখতে শুরু করেছি তখন রাত তিনটে বাজে। অর্থাৎ এখন ১২ তারিখ। ১১ তারিখ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সংসদে সব কোটা বাতিল করে দিলেন তারপরে শান্ত মাথায় পত্রিকা বের করেছি। বাসায় এসে ডিনার করেছি। কাপের পর কাপ গ্রিন-টি খাচ্ছি। বেশ কয়েকটি বই নাড়াচাড়া করেছি। নিজের মনকে শান্ত করার জন্যে মার্ক টোয়েনের গল্প, এমনকি কমলা দাসের কবিতা পড়ারও চেষ্টা করেছি। বারবার পড়া কবিতা। তারপরেও পড়েছি। তবুও মনের ভেতর থেকে একটা অস্থিরতাকে দূর করতে পারেনি। কেবলই মনে হচ্ছে, তাহলে কী প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের যাওয়ার পথে কাঁটা পড়লো। আবার এর ভেতর বিডিনিউজে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের ছোট্ট একটা লেখা পড়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সবিনয়ে অনুরোধ করছেন কোটা পদ্ধতির কথা বলে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করবেন না। যে বীরত্ব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছিলো ঠিক তেমনি বীরত্বের সঙ্গে যোগ্যতার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা তাদের স্থান করে নেবে। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের লেখাটা বীর মুক্তিযোদ্ধার উচ্চারণ। তবে কেন যেন কুকরে দেয় মন। কেন যেন মনে হয়, তাকে শুধু নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হচ্ছে। আবার অন্যদিকে সরকারের প্রতি একটা ক্ষোভও মনের ভেতর কাজ করছে। গত এক সপ্তাহের বেশি ধরে জামায়াত বিএনপি ছাত্রশিবিরের ছেলেদের ঢাকায় নিয়ে এসেছে। বিএনপির এক ব্যবসায়ী নেতা তার অফিসে বসে এগুলো কন্ট্রোল করছে। তারেক রহমান সকলকে ফোন করছে। অথচ সরকার এই কোটাবিরোধী আন্দোলনকে মনে করলো শুধু সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। মাহমুদুর রহমান মান্নার ফর্মুলা অনুযায়ী তারা প্রথম দিন থেকে লাশের চেষ্টা করছে। ফেসবুকে মিথ্যে স্ট্যাটাস দেয় সেজন্য। তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনও ব্যবস্থা নিতে পারলো না সরকার। তাছাড়া ফেসবুকে যেভাবে মিথ্যে পরিসংখ্যান তারা ব্যবহার করছে তারও কোনও জবাব দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। সরকারের বিটিআরসি, আইটি মন্ত্রণালয় কি করে?

যাহোক, শেখ হাসিনার সরকার যে ধীরে ধীরে প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রশাসন তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন সেখানে বড় আঘাত করতে সমর্থ হলো জামায়াত- বিএনপি। তাই বলে তো আর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রশাসন স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে, জামায়াত-শিবিরের কাছে ইজারা দেওয়া যায় না। তাই কোটাবিরোধী আন্দোলন যেখানে গিয়ে দাঁড়াক না কেন, বর্তমান সরকারকে আতাউস সামাদের ওই কথা ভেবে দেখতে হবে যে, যতক্ষণ না প্রশাসনে সকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না হচ্ছে ততক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর এ কাজ করার জন্যে যত কঠোর হোক না কেন, সরকারকে পার্লামেন্টে নতুন একটি আইন পাস করতে হবে। ওই আইনে বিষয়টি স্পষ্ট থাকবে যে পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের ভেতর দিয়ে যদি জানা যায় ব্যক্তিটি রাজাকার বা আলবদর পরিবারের সন্তান  তাহলে তাকে প্রশাসনে, বিচার বিভাগে ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এমনকি তাকে কোনও মিডিয়ার লাইসেন্স বা পারমিশন দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, তারা কোনও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের দাওয়াতও পাবে না। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসেও যখন মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আঘাত করছে, তখন সরকারের বোঝা উচিত ইউরোপে যুদ্ধাপরাধীর সন্তান যুদ্ধাপরাধী হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে রাজাকার আল-বদরের সন্তান রাজাকার আল-বদরই হয়েছে। তাই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখন এ আইন প্রণয়ন করতেই হবে। কেউ কেউ বলতে পারেন, এ ধরনের আইন দেশকে বিভক্ত করবে। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজকার, আলবদররা ‘দেশকে বিভক্ত করবে’- এই ধুয়ো তুলে নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ করে নিয়েছে। আর এর ভেতর দিয়ে দুর্বল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তাই আর ছাড় দেওয়া নয়, যত দ্রুত সম্ভব পার্লামেন্টে বিল এনে এ আইন পাস করতে হবে। এ নিয়ে দ্বিধান্বিত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।

 

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

উপরে