শিরোনাম
সব প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ: প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো শিশুর শরীরে ‘বার্ড ফ্লু’ শনাক্ত টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা সাকিবের ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’— ইউক্রেনের সাবেক সেনাপ্রধান ভারতে মসজিদে ‘সমীক্ষা’ চালানো ঘিরে সংঘর্ষ, নিহত ৩ সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ব্রাজিলে বাস খাদে পড়ে ২৩ জন নিহত নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 3 July, 2018 01:38

উচ্ছ্বাস ভালো, বাড়াবাড়ি নয়

উচ্ছ্বাস ভালো, বাড়াবাড়ি নয়
ইকতেদার আহমেদ :

আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা শব্দ দুটি একটি অপরটির সমার্থক। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা শব্দ দুটি ব্যক্তি ও জাতি উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।

আত্মসম্মান বলতে সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি আপনার মান, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মগৌরব, শ্রদ্ধা, অহংকার ইত্যাদি। একজন ব্যক্তি বা একটি জাতি আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চাইলে ওই ব্যক্তি বা জাতির অবস্থান সবসময় সততা, ন্যায়পরায়ণতা, যথার্থতা, আদর্শপরায়ণতা, নৈতিকতা ইত্যাদির পক্ষে এবং সব ধরনের অন্যায়ের বিপক্ষে হবে।

একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে কখনও নিজের মানসম্মান, কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্য ইত্যাদিকে জলাঞ্জলি দিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে নিজের ব্যক্তিসত্তা ভূলুণ্ঠিত হয়। এ কথাটি সমভাবে একটি জাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ক্রীড়া একটি জাতির ঐতিহ্যের অংশ। তবে সব জাতি সমভাবে সব ধরনের ক্রীড়ায় পারদর্শী নয়। ক্রীড়ায় পারদর্শিতার ক্ষেত্রে জাতিগত বৈশিষ্ট্য, শারীরিক গঠন ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে ফুটবল সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আসছে।

বিগত শতাব্দীর তৃতীয় দশকের সূচনালগ্নে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতি চার বছরের বিরতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের মহোৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন দুটি বিশ্বকাপের আয়োজন স্থগিত রাখা হয়েছিল।

ফুটবলের বিশ্বকাপ খেলা আয়োজনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও বেশ কয়েকটি খেলা যেমন- ক্রিকেট, টেনিস, গলফ, দাবা ইত্যাদিতে বিশ্বকাপের প্রচলন হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে অপর কোনো খেলা এখনও ফুটবলের ধারেকাছেও আসতে পারেনি।

বিগত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের পর থেকে বিশ্বের ধনী-দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে টিভি সহজলভ্য হওয়ায় বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ টিভির বদৌলতে তাৎক্ষণিক আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত ফুটবলসহ অপরাপর খেলাগুলো উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে।

আমাদের দেশে টিভির সহজলভ্যতা সার্বজনীন না হওয়ায় সমাজের একটি বিরাট অংশ পারিবারিক সীমানার বাইরে সামাজিক ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত খেলাগুলো, বিশেষ করে ফুটবল খেলা দেখার সুযোগ পাচ্ছে।

আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগ পর্যন্ত আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। দেশীয়ভাবে ফুটবল খেলার আশানুরূপ বিকাশ না ঘটায় এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে ফুটবল খেলায় আমাদের সামর্থ্য সীমিত থাকায় বর্তমানে বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ক্রিকেট ফুটবলের স্থান দখল করে নিয়েছে।

কিন্তু এরপরও দেখা যায় যখন বিশ্বকাপ ফুটবলের আগমন ঘটে, তখন এ খেলা উপভোগের জন্য জনগণের কোনো অংশের মধ্যেই আগ্রহের কমতি থাকে না।

আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেরও সর্বাধিক জনগণ উপভোগ করে থাকে।

বিশ্বকাপ ফুটবলে সবচেয়ে বেশি পাঁচবার কাপ বিজয়ী হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার বৃহৎ দেশ ব্রাজিল। দক্ষিণ আমেরিকার অপর দুটি দেশ উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা দু’বার করে বিশ্বকাপ বিজয়ী হয়েছে। ইউরোপীয় দেশের মধ্যে ইতালি ও জার্মানি চারবার করে বিশ্বকাপ বিজয়ী হয়েছে।

আমাদের দেশে বর্তমানে ফুটবলের যে মান, সেই নিরিখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলায় আমাদের অংশগ্রহণ সুদূরপরাহত বলা চলে।


 
কিন্তু তাই বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেসব দেশ ভালো মানের ফুটবল খেলে পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমী দর্শকদের মুগ্ধ করছে, তাদের সমর্থন করতে আমাদের বাধা কোথায়? তাই বিগত ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আমাদের ফুটবলপ্রেমীদের একটি বড় অংশ ব্রাজিলের এবং অপর একটি বড় অংশ আর্জেন্টিনার সমর্থক। এর বাইরে জার্মানি, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের বিচ্ছিন্ন সমর্থক রয়েছে। আমরা এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। এশিয়া মহাদেশের কোনো দেশ এখনও ফুটবলের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। তাই আমাদের দর্শকদের মধ্যে এখনও এশিয়ার কোনো দেশের পক্ষে জনমতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন সমর্থকগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়নি।

বিগত কয়েকটি বিশ্বকাপ ফুটবলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উদ্বোধনী খেলা শুরু হওয়ায় ন্যূনপক্ষে ৬ মাস আগে থেকেই, বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থকরা হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাড়ির ছাদে, গাছের উপরে, সাইকেল, রিকশা, গাড়িতে উভয় দেশের পতাকা উড়িয়ে নিজেদের পছন্দের দলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করছে।

আমাদের ফুটবলপ্রেমিকদের এ ধরনের অন্ধ সমর্থনের কারণে দেখা যায়, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলাকালীন উভয় দেশের বিভিন্ন আকৃতির কয়েক লাখ পতাকা একটি অপরটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে। পতাকা উড়ানোর সময় এক ভক্তের পতাকা থেকে অপর ভক্তের পতাকা কত বড় ও কত উঁচুতে উড়ছে, তা নিয়েও অনেক বাকবিতণ্ডতা হয়।

ভক্তদের এ মানসিকতার কারণে পতাকা সেলাইয়ের কাজে নিয়োজিত একশ্রেণীর দর্জির বিশ্বকাপ শুরুর আগমুহূর্ত থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নেয়ার অবকাশ থাকে না।

প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে আমাদের ফুটবলপ্রেমিকরা তাদের প্রিয় দলের যতসংখ্যক পতাকা ক্রয় করে থাকেন, তাতে ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ কোটি কোটি টাকা হবে এবং এর পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের মতো গরিব দেশে এ অর্থ দিয়ে অনেক গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব।

ভক্তদের মাঝে দেখা যায়, প্রিয় দলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে গিয়ে পতাকার বাইরে প্রিয় দলের জার্সি পরিধান করছে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রিয় দলের প্রিয় খেলোয়াড়ের ক্রমিক নম্বরের জার্সি পরে তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশ করছে।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কলকারখানার শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য অংশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের প্রতি নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করতে গিয়ে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছে।

এ বিভক্তি থেকে প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটছে। এ ধরনের ঘটনায় দু’একটি ক্ষেত্রে জীবনহানি পর্যন্ত ঘটছে।

আমাদের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ও গ্রামগঞ্জে পতাকায় উড়ন্ত অবস্থান থেকে অতি সহজেই ধারণা করা যায় কাদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা হচ্ছে। এ সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই অন্তর্ভুক্ত।

অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ আরও কয়েকটি দেশের পতাকার ছড়াছড়ি হলেও আমাদের যে কোনো জাতীয় দিবসের সময় দেখা যায় এর সিকিভাগ পতাকাও উত্তোলিত হয় না।

এটা জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করে। আমরা আরও লজ্জিত হই যখন দেখি, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলকে নিয়ে আমাদের এত উচ্ছ্বাস ও মাতামাতি অথচ সে দুটি দেশের অধিকাংশ জনগণের আমাদের দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। কথিত আছে, ১৯৯০ সালে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবল খেলোয়াড় দিয়াগো মেরাডোনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন- বাংলাদেশ কোথায়?

যে কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা একজন মন্ত্রী রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তি। এ ধরনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন, কোনো আন্তর্জাতিক খেলায় তারা প্রকাশ্যে নিজের দেশের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু ভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের আন্তর্জাতিক খেলায় একটি দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কাউকে বলতে শোনা যায় না আমি এ দেশ বা ওই দেশের সমর্থক।

এক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী কোনো এক বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এবং সাংবাদিকরা শত চেষ্টা করেও বের করতে পারেননি বিশ্বকাপ ফুটবলে তারা কোন দেশকে সমর্থন করছেন। তাদের একজন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, আপনারা যে দলের সমর্থক আমিও ওই দলের সমর্থক।

আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমরা আমাদের পতাকা, আমাদের মধ্যে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় এবং কীর্তিমান, তাদের নিয়ে মাতামাতি বা বাড়াবাড়ি করব।

তাতেই ব্যক্তি হিসেবে আমাদের আত্মসম্মান এবং জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের মতো এভাবে পৃৃথিবীর অন্য কোনো দেশের জনগণ কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সময় ভিন দেশের পতাকা উড়িয়েছেন এমনটি শোনাও যায়নি, দেখাও যায়নি।

 


লেখক : সাবেক জজ এবং সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

উপরে