নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা-আশঙ্কা
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। দু’কথা বলতে চাইছি, কিন্তু সংকোচ কাটছে না। কোনটা যে উসকানি আর কোনটা যে সমর্থন তার ফারাক করাটাই দায় হয়ে পড়েছে। ওই যে বললাম ‘সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে’। কেউ রেগে গিয়ে বলতেই পারেন যে, ঠিকঠাক না থাকার কি কোন কারণ আছে?
আপনি অন্য কোন পক্ষকে উস্কে দিচ্ছেন না তো? না ভাই, কাউকে উস্কানি দিচ্ছি না, এমনতর ভাষাতেই আমরা আমজনতা কথা বলি।
এটাতো ঠিক যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতার হাত বদলের একমাত্র মাধ্যম হলো একটি সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন। সে নির্বাচনে কে অংশগ্রহণ করলো আর কে করলো না তাতে কিছু যায় আসে না-এমন কথা কেউ বলতেই পারেন। কথাটা হয়তো আইনগতভাবে সঠিক কিন্তু নীতিগতভাবে তা সুখকর নয়। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে তার সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা অধিকতর ফলদায়ক হয়, গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। সে কারণেই সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা চাই।
আমরা এও জানি যে এধরণের ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কোন আশা নেই, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার জন্যেই প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন প্রয়োজন। প্রণম্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সুর ধরেই বলতে হয়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি হারবে না, হেরে যাবে মেহনতি মানুষ।
একাদশ নির্বাচন হবেই-এ আমি নিশ্চিত। তবে কথা হলো তার রূপটি কেমন হবে? মিলেমিশে একটা নির্বাচন হবে, হারজিত যারই হোক ব্যস। কিন্তু মিলেমিশের পরিবেশ কি আছে?
আমি তো মামুলি ইনসান। এদেশের বরেণ্য তিনজন শিক্ষাবিদের মতামতগুলোর দিকে একটু তাকাই। অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন,‘ এ সংকট উত্তরণে একটা সংলাপ হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ সংলাপ হতে পারে। হতে পারে নির্বাচন কমিশনের মধ্যেও। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দু’টি রাজনৈতিক দল ওয়ান টু ওয়ান আলাপ করতে পারে। আবার যদি সম্ভব হয় তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধানের পথে আসতে হবে।’
অপর শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে সংঘাতের আশঙ্কা তো আছেই। আমরা সেটা আশা করবো না । আমরা আশা করবো এমন একটা নির্বাচন হওয়া যাতে মানুষ ভোট দিতে পারে।
সম্প্রতি শেষ হওয়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তাই এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের, এ মুহুর্তে যারা সরকারে আছেন।’ অর্থাৎ ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তাটাও চান।
তৃতীয় শিক্ষাবিদ এমাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘ আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সমাধানে না এলে দেশ আবার চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বড় দুই দল এক টেবিলে বসলে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে আশা রাখি।’
অবশ্য তিনি এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই তিনজন শিক্ষাবিদের মতামতকে একই ধরণের বলতে পারি- আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা।
অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম ভোটাধিকার নিশ্চিত করার যে বিষয়টি এনেছেন, সমঝোতার পরেও তার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে হবে। বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক বা সংস্কৃতি কর্মী তারা শুধু মতামতই ব্যক্ত করতে পারেন-বাস্তবরূপ দেবার ক্ষমতা তাদের নেই। যাদের আছে তারা হলেন রাজনীতিক, দেশমাতার ভাগ্য নির্ধারণের প্রকৌশলী। তাদের মতামতটা জানা দরকার।
সরকারি মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে, এখানে আলাপ আলোচনার কিছু নেই। নির্বাচন কমিশন দিন-তারিখ ঠিক করবে আমরা তাতে অংশগ্রহণ করবো, কারো আসা না আসায় কিছু যায় আসে না। অপর দিকে বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে এবং নির্বাচনকালীন একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
যদি এমনটি না হয় তাহলে নির্বাচন বয়কট এমন কি প্রতিহতের ব্যাপার-স্যাপারও আসতে পারে। সরকারি দল দু’কথা বলে দায় সেরেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ উচ্চ আদালতের এখতিয়ার, আর কেয়ারটেকার বা নির্দলীয় সরকারের ধারণা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক-সুতরাং আমাদের তো কিছু করার নেই! এদিকেই মোটামুটি এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাহলে উপায়? এতটা অনমনীয় হবার কারণ?
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে আমার মনে একটি ধারণার জন্ম হয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল। সেসময়কার উভয় দলের কর্মীদের ভেতর এমন ধারণা ছিল, যে জেতার জন্য কাজ করবো, না জিতলে সংসদ ও রাজপথে সরকারের ভুল –ত্রুটি নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ করবো। হলোও তাই, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলেই রইল, সমস্যা তেমন কিছু ছিলো না। কিন্তু আজকে উভয় দলের মানসিক অবস্থা ’৯১ সালের মতো নেই।
কুষ্টিয়াতে অনুষ্ঠিত যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেই ফেললেন যে, এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না গেলে আমাদেও পিঠের চামড়া থাকবে না। অন্যদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভাবছে যে এবার যদি ক্ষমতায় যেতে না পারি তাহলে আর তিরিশ বছরেও সরকার গঠন সম্ভব হবে না। আমি এটাকে বলতে চাই ‘অস্তিত্বের সংকট’। এধরণের সংকটে মানুষ ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’র দিকে ধাবিত হয়। এমনতর অবস্থার কথা আমরা ভুল করেও ভাবতে পারি না। তাই আমার মনে হয় দু’দলের মধ্যে অস্তিত্ব বিলীন হবার মতো অপঘটনার ওপর বিশ্বাস বিলোপ করতে হবে এবং তা গণতন্ত্রের স্বার্থেই। প্রত্যেকেই নিজেদের কঠোর মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। আমরা আর সংঘাতের রাজনীতি দেখতে চাই না। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: মুঈদ রহমান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।