বৃদ্ধাশ্রম
॥ রিয়াজুল হক ॥
পিতা-মাতাকে সেবা যত্ন করার মাঝে কোন মহত্ব নেই। প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব। কিন্তু পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা শুনলে অনেক সন্তান এখন বিরক্ত হয়ে বলে থাকেন, একই ধরনের তত্ত্ব কথা সবসময় শুনতে ভালো লাগে না। পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব সেটাও এখন তত্ত্ব কথা হয়ে উঠেছে। কি বিচিত্র আমাদের চিন্তা ভাবনা!
এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুইটি বন্ধ করুন। বাবার হাতের আঙুল ধরে হাঁটার অনুভুতি একবার মনে করার চেষ্টা করুন কিংবা বাবার চওড়া কাঁধের উপর উঠে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিগুলো। আপনার অসুস্থতার সময় রাত জেগে মায়ের সেবা যত্নের মুহূর্তগুলো।
জীবনের মূল্য কত? চোখ বন্ধ করলে কিছুই সাথে নিতে পারবেন না । কিসের অহংকার আপনার? ক্যারিয়ার, সঞ্চয় বৃদ্ধির মোহে জীবনটাই শেষ করে দিলেন। আপনার আয় কম, স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়া হয়না, ঘরের জায়গা কম, সন্তানের পড়ালেখায় সমস্যা হয়, এইসব অজুহাতে আপনি আপনার পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলেন। আপনার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনি হেলায় হারিয়ে ফেলছেন। ভালোবাসা সবসময় নিম্নগামী। আপনার জন্য আপনার পিতা-মাতার যে অনুভূতি, আপনার প্রতি আপনার সন্তানেরও সেই পরিমাণ অনুভূতি নেই। অন্যদের কথা বস্তায় ভরে রাখুন।
আজ আপনি দামী গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্ত্রী, সন্তানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আত্মীয় স্বজন নিয়ে দেশ বিদেশে নিয়মিত যাতায়াত। বড্ড বেমানান লাগে বৃদ্ধা পিতা-মাতাকে সাথে নিতে। অনেক তথাকথিত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ত্ব পিতা-মাতা বেঁচে আছেন, সে কথা বলতেই লজ্জা পান। আবার পরিচয় করিয়ে যদি দেয়া লাগে। মাঝে ,মাঝে মনে হয় আমাদের বাবা-মায়েরা সন্তান মানুষ করতে গিয়ে বড় ধরনের ভুল করে থাকেন। সন্তানের জন্য এত কষ্ট করার কি দরকার। লেখাপড়া না শিখিয়ে যদি ছোটবেলায় কৃষি কাজে কিংবা কারখানার কাজে লাগিয়ে দিতেন, তবে সন্তান অন্তত নিজের মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা পেত না।
দুই. সন্তানের উদ্দেশ্যে লেখা বৃদ্ধাশ্রমে ৬ বছর ধরে বসবাসরত ৮০ বছরের বৃদ্ধা অসহায় মায়ের চিঠিটার কিছু অংশ উল্লেখ চাইছি। “ বাবা.. আমার আদর, ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে? রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না? তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন চায়। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও (সংগৃহীত)।
তিন. পুত্রের কাছে পিতার লেখা চিঠিটি যে কোন কঠিন হৃদয়ের মানুষের চোখেও জল এনে দেবে। চিঠির উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরছি, ’প্রিয় সোনামানিক, তুমি কেমন আছো একথা জিজ্ঞাসা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক মনে করছি। তুমি ভাবছো হয়ত তোমার বাবা আগের মত তোমায় ভালোবাসে না। যদি এটা ভেবে থাক তবে তোমার সেই ছোট্টবেলার মত আরেকটি ভুল করলে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি তুমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো আছ কেননা আমরা দোয়া যার সাথে সর্বদা জড়িয়ে থাকে সে খারাপ থাকতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করিনা।
তোমার হতভাগ্য-হতদরিদ্র জন্মদাতা তোমার চাহিদা তো দূরের কথা মৌলিক চাহিদাও সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করতে পারেনি কিন্তু তুমি তো গরীব নও। সুতরাং ছেলে-মেয়ের কোন শখ যেন অপূর্ণ না থাকে। তোমাদের দোয়ায় আমিও অনেক ভালো আছি। পাশের রুমের গণি মিয়া আমার সূখ দেখে ঈর্ষা করে কেননা তুমি প্রতি বছর দু’ইবার আমার কাছে ছুটে আস। তোমার ব্যস্ততা রেখে তোমাকে আসতে বারবার নিষেধ করি তারপরও তুমি কেন আস তা আমি বুঝতে পারি না। এটা ভেবোনা যে, তুমি না আসলে আমি তোমায় ভুলে যাব কিংবা কম দোয়া করবো বরং তোমাদের প্রতি দোয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কেননা দিন দিন যেভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছি তাতে আমার পৃথিবীটা সংকুচিত হতে হতে আমার এক চোখ ভাঙা চশমাটির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফসুস বেচারা গণি মিঞার জন্য! ওর সন্তানগুলো ওকে এখানে রেখে যাওয়ার পর একবারও খোঁজ নেয়নি; শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া। প্রিয় পুত্রধন!
এখানে যে ছেলেটা আমাদের দেখাশুনা করে সে ছেলেটার মত ছেলে খুব কম দেখা যায়। ওর সম্পর্কে বললে তোমার মনে হবে এই জগতেও এমন বোকা ছেলে আছে! সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাতে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে, কাকা! কিছু লাগবে? ওর আচরণে তোমার অনুপস্থিতিতে বুকের মধ্যের শূন্যতা কেমন যেন পূণ্য হয়ে যায়। ছেলেটা খুব গরীব। দিনরাত পরিশ্রম করে এখান থেকে যা মাইনে পায় তা দিয়েই ওর বাবা-মা এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলতে হয়। আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কষ্টের কথা শুনি; আমার মত অক্ষম-অলসের এর বাইরে তো আর কোন কাজ থাকে না। আমার ইচ্ছা হয় ওকে কিছু বাড়তি টাকা দেই। কিন্তু আমার সে সাধ্য তো নাই। ছেলেটাকে বলেছিলাম ওর বাবা-মাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসতে। এ কথাশুনে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলেছে, রক্ত বিক্রি করে হলেও বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখবে; কোনদিন বৃদ্ধাশ্রমে দিবে না। ছেলেটার কথা শুনে ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্ষণিক পরেই বুঝলাম আমি হয়ত আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছি! তাই এ নিয়ে আর ও ছেলেটার কাছে কিছু বলতে যাইনি। অল্পশিক্ষিত একটি ছেলে তার বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাবছে সেটা কেবল আবেগের কথা!
চার. যারা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, প্রত্যেকে একবার ভেবে দেখুন বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবার দিনটির কথা। মায়েরা নিজেরা না খেয়ে আপনার আমার মত সন্তানদের খাইয়েছে। আমরা অধিকাংশই নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য প্রত্যেকের বাবা-মাকে দিন রাত পরিশ্রম করতে হয়। অথচ আধুনিকতার নামে আমরা সত্যিই অসভ্য, বর্বর হয়ে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছে, বৃদ্ধ এবং ছেলের ওপর নির্ভরশীল বাবা-মায়ের থেকে স্বামীকে নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করতে জোর করলে স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে পারবেন। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে কোর্ট এই রায় দেয়, সেটা সহজেই অনুমেয়। আমাদের দেশেও ক্রমে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যা কাম্য হতে পারে না। প্রত্যেক সন্তানের মাঝে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, পিতা-মাতার সেবা যত্ন করুক, বন্ধ হয়ে যাক বৃদ্ধাশ্রমগুলো, এই প্রত্যাশায় থাকলাম।
লেখকঃ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।