শীত মৌসুমে ধুলা দূষণে ঢাকবে ঢাকা
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন দূষণ নিয়ে ভাবতে হয় গবেষকদের। এমনই এক দূষণ ধুলা দূষণ। শুষ্ক মৌসুমে ধুলা দূষণের পরিমাণ অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেকাংশে বেড়ে যায়। বায়ুতে নিজ উপাদানের অতিরিক্ত বা অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু মিশ্রিত হয়ে বায়ুর গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার বিষয়টিই বায়ু দূষণ।
আর বায়ুতে সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পিএম ২.৫ থেকে পিএম ১০ মাইক্রোগ্রাম) অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে মানুষ ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার বিষয়টিই ধুলা দূষণ বলে বিবেচিত। ধুলা দূষণের প্রকট এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে বর্তমানে এ নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হচ্ছে।
গ্রামের চেয়ে শহরে ধুলা ও বায়ু দূষণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এ দূষণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা। বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউট এবং ইন্সটিটিউট ফর হেলথ ইভাল্যুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে তৈরি প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ু দূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার।
রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ঢাকায় ১০ হাজার মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ক্যান্সার সংস্থা পিএম ২.৫কে ‘জি-১ কার্সিনোজেন’ তালিকাভুক্ত করেছে। বায়ু ও ধুলা দূষণ শুধু স্বাস্থ্যহানি জন্য দায়ী নয়, আমাদের পরিবেশ ও আর্থিক ক্ষতির জন্যও দায়ী।
বিশ্বব্যাপী বায়ু ও ধুলা দূষণের অবস্থা : বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বায়ু দূষণ নিয়ে ভুগছে বিশ্বের অনেক দেশ, এর মধ্যে ভারতের দিল্লি শহর বায়ু দূষণে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে আছে পাকিস্তানের করাচি এবং চীনের বেইজিং।
১৯৯৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের বায়ু সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে বাংলাদেশকে। ইউনিসেফের এক গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়।
বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৫ বছর পর্যন্ত বয়সী ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। বায়ু দূষণজনিত রোগে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এ বছর মে মাসে ভারতের উত্তর ও পশ্চিম এলাকায় ধূলিঝড়ের কারণে ১২৫ জন মৃত্যুবরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি, পশুপাখি, গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঢাকার বায়ু ও ধুলা দূষণের উৎস : শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার আশপাশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইটভাটায় ইট তৈরিতে পোড়ানো হয় অতিরিক্ত কাঠ কয়লা, কাঠের গুঁড়া, ফার্নেস অয়েল, এমনকি বাতিল টায়ারও। এর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড, যা দূষিত করছে ঢাকার বায়ুকে।
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ৫৮ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী ইটেরভাটা। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে শিল্পকারখানা, যানবাহনের অসম্পূর্ণ দহন থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের প্যাটিকুলেট ম্যাটার, অ্যাশ, ধূলিকণা, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই মিশে যাচ্ছে বায়ুতে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ এবং ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকার ১২টি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করা হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুতে পিএম ২.৫-এর পরিমাণ আদর্শ মানমাত্রার চেয়ে অনেকাংশে বেশি।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ধানমণ্ডি এলাকার সিসা দূষণের ওপরও অন্য একটি গবেষণা করেছে। গবেষণায় ১০ স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ গবেষণায় প্রতিটি স্থানের নমুনায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
পরিবেশের দূষণগুলোর মধ্যে পিএম ২.৫ সিসা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত এবং সংস্কার কার্যক্রমের নামে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বায়ুতে ধূলিকণা মিশ্রিত হয়ে যায়।
ড্রেন পরিষ্কারের পর বর্জ্যসমূহ রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়, যা ধুলা দূষণের জন্য দায়ী। উপরন্তু ড্রেনের বর্জ্যে প্যাথজেনের উপস্থিতি থাকার কারণে নির্মল বায়ু হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। ভবন নির্মাণসামগ্রী (ইট, বালি, মাটি, সিমেন্ট, খোয়া) এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খোলা অবস্থায় পরিবহন, পুরনো ভবন ভাঙা, নতুন ভবন নির্মাণ, মেশিনে ইটভাঙার কারণে ধুলা দূষণ বৃদ্ধি পায়। ব্যাটারি, পেট্রল, ডিজেল, হেয়ার ডাই, পাউডার রঙ ইত্যাদি পণ্য থেকে বায়ুতে ধুলা মিশ্রিত সিসা যুক্ত হচ্ছে।
এছাড়াও রং, সিলমোহর ও কাঠশিল্প থেকে ফরমালডিহাইড বায়ুতে যুক্ত হয়ে বায়ুর গুণগতমান নষ্ট করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ ইঞ্জিন পরিচালনা, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরি এবং ভারি ধাতু নিষ্কাশনের সময় তামা, সিসা, ক্যাডমিয়াম বায়ুতে মিশে যায়। গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত কয়লার চুলা এবং জ্বলন্ত কাঠ থেকে অতি ক্ষুদ্র কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যা বায়ুকে দূষিত করছে। আবার যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখার কারণে রোগ জীবাণু ধুলার সঙ্গে মিশে বায়ুকে দূষিত করছে।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ু ও ধুলা দূষণের প্রভাব : ধুলা দূষণের ফলে ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলো মধ্যে নাক-মুখ জ্বালাপোড়া করা, মাথা ঝিমঝিম করা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি অন্যতম। ধুলা মিশ্রিত জীবাণু, ভারি ধাতু, গ্যাসীয় রাসায়নিকের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষ্মা, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক, যকৃত সমস্যা, গর্ভবতী মায়েদের ওপর প্রভাব, চর্মরোগ, নিউমোনিয়া ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা সমস্যা দেখা দেয়।
বায়ু দূষণের আইন ও শাস্তি : বাংলাদেশ সরকার বায়ু দূষণ রোধে বিভিন্ন আইন করেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ৬-এর উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবে না বা ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনোভাবে উক্ত যানবাহন চালু করা যাইবে না।’
ধারা ৬-এর উপধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘনকারীকে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড; দ্বিতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হবে। ইটভাটার দূষণ রোধের আইনে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১ বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ বায়ু দূষণ কমানোর জন্য সরকার ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট তৈরির কাজ করছে।
বায়ু দূষণ রোধে আমাদের করণীয় : বায়ু দূষণ কমাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা ও আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ইট তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও কম সালফারযুক্ত কয়লার ব্যবহার করতে হবে। নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, সব আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক পরিবহন ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ইটভাটায় সর্বাধুনিক পদ্ধতি এবং যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার : বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
[email protected]