শিরোনাম
সব প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ: প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপে তৎপর ভারতীয় আমেরিকানরা টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা সাকিবের প্রথমবারের মতো ইউক্রেনে রাশিয়ার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় ভারতীয় সেনা নিহত সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর গাজায় ১০০ ট্রাক ত্রাণ লুট করে নিল মুখোশ পরিহিতরা নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 4 November, 2019 19:45
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল

অভিন্ন সমৃদ্ধি ও টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান সুযোগ

অভিন্ন সমৃদ্ধি ও টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান সুযোগ
আর্ল আর. মিলার :

ইতিহাসের এই ক্ষণে আমি বাংলাদেশের বদলে অন্য কোনো দেশেই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হতে চাইতাম না। অসাধারণ এই দেশটিতে আমার পৌঁছানোর এক বছর পুর্তি ঘনিয়ে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের ভাগিদার হতে পেরে আমি নিজেকে দারুণ সৌভাগ্যবান মনে করছি। প্রতিদিন অনেক চৌকস লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সফল হওয়ার জন্য তাদের যে আবেগ, মেধা ও সংকল্প তা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এসব মানুষের মধ্যেই এ দেশের সর্বোত্তম ছবিটা প্রতিফলিত হয়। তাদের মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা সারা বিশ্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সারা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণবন্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চিত্তাকর্ষক ইতিহাস, বিপুল প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলটি বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাও একটি ইন্দো-প্যাসিফিক দেশ হিসেবে এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মোট প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দাঁড়িয়েছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। এ মাপের বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে কারণ এটি গড়ে ওঠে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান, নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা, উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ বিনিয়োগ পরিবেশ এবং দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি মৌলিক নীতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শক্ত ভিতের ওপর। এ অঞ্চলের জন্য ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ নামে পরিচিত আমাদের সরকারের দূরকল্পটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক এটাই। সংক্ষেপে বললে, যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের পক্ষে, যাতে বাংলাদেশের মতো সার্বভৌম ও স্বাধীন দেশগুলো স্বাধীনভাবে ও শান্তিতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে। যেখানে এ অঞ্চলের বড়ো-ছোটো যে কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের অঙ্গুলি হেলনে প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে পারবে। এই কৌশলের মধ্য দিয়ে আমরা অভিন্ন মূল্যবোধ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার ধারণাকে এগিয়ে নিচ্ছি।

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূরকল্প এমন কিছু বিধিবিধানের সমষ্টি যা আমাদের ইতিমধ্যেই জানা। স্বাধীন ও স্বচ্ছ সরকারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা স্থিতিশীলতা আর উন্মুক্ত ও নিয়মনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জিত নিরাপত্তা এ অঞ্চলে আরো কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বেসরকারি বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তা নিশ্চিতভাবেই বয়ে আনবে সুযোগ ও সমৃদ্ধির জোয়ার।

সমৃদ্ধির কথা বলার সময় আমরা বেসরকারি খাত দ্বারা চালিত বিনিয়োগের কথাই বলি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী আগামী কয়েক বছরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবকাঠামো খাতে যে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, সরকারি অর্থায়ন বা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের মাধ্যমে কোনো দেশই তা জোগাতে পারবে না। তবে বেসরকারি খাত একা এবং এ অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে তা করতে সক্ষম। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সংকুলান ঘটিয়ে সে কাজটাই করতে চায়, যা এটি সবচেয়ে ভালো পারে। আর তা হচ্ছে—এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উদ্ভাবন এবং দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কৌশলের মনোযোগের জায়গাটি হচ্ছে বিশেষ করে চলমান অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রসার ঘটানো, বেসরকারি বিনিয়োগ কাজে লাগানো এবং গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিবেশ গড়ে তোলা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা, ধারণা বিনিময় এবং আদর্শ কর্মপন্থা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের অংশীদাররা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এতে করে বাজার সম্প্রসারণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করার সুযোগ তৈরি হবে।

বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, তা নিশ্চিত করতে আমাদের দূতাবাসের কর্মীবৃন্দ এ দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে আট ধাপ উন্নতি করায় আমরা বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাই। আমরা উভয় পক্ষই জানি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতা, দুর্নীতি এবং দুর্বল শ্রম পরিস্থিতিমুক্ত বিনিয়োগের পরিবেশ চায়। বাংলাদেশের কর্মপ্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হলে তা এসব ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিরসনে সহায়তা করবে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করবে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের আওতাধীন বিভিন্ন কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে জ্বালানি, অবকাঠামো এবং ডিজিটাল অর্থনীতি খাতের সম্ভাবনাগুলো উন্মোচন করা, যা হবে আজ ও আগামীর প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, একটি আন্তর্জাতিক বিধিভিত্তিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতি এগুলো পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আন্তর্জাতিক বিধি, আইনকানুন এবং মান মেনে চলা ছোটো-বড়ো সব দেশ স্বাধীনতা এবং শান্তির ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। স্বাধীনতা রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদার করার অঙ্গীকার নবায়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি আরো বাড়ানো সম্ভব হবে এ দৃঢ়বিশ্বাসই হচ্ছে আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মূল ভিত্তি।

একটি স্থিতিশীল, মুক্ত এবং উন্মুক্ত অঞ্চল নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের যে দূরকল্প তার জন্য প্রয়োজন অভিন্ন নিরাপত্তাও। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের জন্য জরুরি নৌপথগুলো রক্ষার জন্য আমরা আমাদের মেরিটাইম সিকিউরিটি এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভের আওতায় অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কাজ করি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এসব উদ্যোগের তহবিলে সংগৃহীত সরঞ্জামসমূহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ এবং স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সনাক্ত এবং প্রতিরোধে সহায়তা করে। গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশ তার সমুদ্র নিরাপত্তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, তার স্বার্থ রক্ষা করছে এবং ক্ষতি করতে চায় এ রকম সম্ভাব্য শক্তিকে ঠেকাতে আমাদের সঙ্গে কাজ করছে।

এ কথাটি জোর দিয়ে বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারদের সঙ্গে অভিন্ন নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দূরকল্পটি অন্তর্ভুক্তিমূলক। একটি স্বাধীন ও উন্মুক্ত অঞ্চলের ব্যাপারে আমাদের দূরকল্প কোনো দেশকেই বাদ দেয় না। আমরা সব দেশের গঠনমূলক অংশগ্রহণকে স্বাগত জানাই, যা একটি সুস্পষ্ট, ন্যায্য এবং স্বচ্ছ বিধিবিধানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখে। তবে ইন্দো-প্যাসিফিকের অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়া স্বাধীন ও উন্মুক্ত মানগুলোর প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জ দেখলে আমরা তাকে প্রতিহত করব। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইন, বিধি এবং মানকে মেনে চলে এমন একটি বিধিবিধানভিত্তিক ব্যবস্থাই ছোটো-বড়ো সব দেশকে সর্বোত্তমভাবে স্বাধীনতা এবং শান্তিতে উন্নতি করার সুযোগ করে দেয়।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তারা বাংলাদেশের বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি এবং ব্র্যান্ডগুলো এনে এবং বাংলাদেশি পণ্য ও লোকজনের জন্য রফতানি ও অন্যান্য সুযোগ সৃষ্টি করে প্রবৃদ্ধি আনে, যা উভয়ের জন্য উপকারি। যেমন শেভরন শুধু বাংলাদেশের চমকপ্রদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাসই সরবরাহ করে না, এ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এর মানুষের পেছনেও বিনিয়োগ করে। শেভরনের কর্মীদের ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি এবং এটি হাজারও বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, স্থানীয় জনসাধারণের উন্নয়নেও কাজ করছে। কোম্পানিটি ‘কোয়ালিটি এডুকেশন সাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ’-এর মাধ্যমে কয়েকশ বৃত্তি দেয় এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাগত উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করে। কোকাকোলা বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে নারীদের ব্যবসা কেন্দ্রের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা করে।

আমেরিকান এবং বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে জোরদার অংশীদারিত্বের আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশকে একইভাবে উপকৃত করে। আগামী ৪ নভেম্বর ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় ইন্দো-প্যাসিফিক বিজনেস ফোরাম আমাদের এই বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করার আরেকটি সুযোগ। আমি এ ফোরামে ১৭টি বাংলাদেশি কোম্পানির একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতীক্ষা করছি। আমি নিশ্চিত যে, আমেরিকান এবং বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর একসঙ্গে কাজ করার অনেক নতুন সুযোগ আসবে, যা অভিন্ন মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমাদের উভয় মহান দেশের জনগণের জন্য আরো বেশি প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।

 

লেখক : বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত

উপরে