শিরোনাম
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত আকাশসীমা বন্ধ করল জর্দান-ইরাক টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা সাকিবের যুক্তরাজ্যে টাটার কারখানা বন্ধ, প্রায় ৩ হাজার মানুষ কর্মহীন অক্টোবরে পাকিস্তান যাচ্ছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন ইমদাদুল হক মিলন ও মাহবুব ময়ূখ রিশাদ বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করল ইরান নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 21 March, 2020 01:32

শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্বনেতা....

শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্বনেতা....

 ড. মোঃ মোফাকখারুল ইকবাল: 

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অবিচ্ছেদ্য। হাজার বছর ধরে বাঙালি নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে অকপটে নিজেদের ভাষায় কথা বলে নিজেদের সংস্কৃতিতে বসবাসের সুযোগ পায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণায়। তাঁর আপসহীন সাহসী সংগ্রামী জীবনের বেশীর ভাগ সময় কেটেছে জেল, জুলুম আর অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে। কিন্তু এমন দুর্গম পথ অতিক্রম করেছেন শুধুমাত্র বাঙালির চির মুক্তির জন্য। শেখ মুজিব এমন এক নেতা ছিলেন যিনি বাঙালিকে দিয়েছিলেন একটি ভূখন্ড, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। 

বাংলা নামে দেশের জনগণ ধীরে ধীরে অবগত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর অপরিহার্যতা। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন। এক অনন্যসাধারণ বৈচিত্রময় ইতিহাসের নাম হলো শেখ মুজিবুর রহমান। কালের যাত্রায় বিচিত্র পরিমন্ডল পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে আদর্শিক ও নেতৃত্বগুণে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্ববন্ধু।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া শেখ মুজিবুর রহমান পরোপকারী, সাহসী নেতৃত্বের কারণে মাধ্যমিক স্কুলে অধ্যয়ণকালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আনুকল্য লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের সহচর্যে আসার সুযোগ পেয়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হয়ে তেজোদীপ্ত নেতৃত্বগুণ অর্জন করার অপার সুযোগ আসে। শেখ মুজিব ইললামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর মুসলীম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ঔপনিবেশিক রাজনীতির প্রান্তিকে ভারতবর্ষে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর ভয়ঙ্কর রায়টের চূড়ান্ত পর্বে ছাত্রনেতা শেখ মুজিব যে অসামান্য দায়িত্ব পালন করেছেন তা-ই শীর্ষ নেতৃবৃন্দের আস্থা অর্জন করেন। শেখ মুজিব বাঙালিদের মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রশিক্ষণ পর্ব আত্মস্থ করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে শেখ মুজিব গৃহাভ্যন্তরীন নেতাজী  সুভাষ চন্দ্র বসুর সহচর্য অর্জন করেন। তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট আদর্শিক মিল রয়েছে। গড়ের মাঠে নেতাজী যেমন বলেছিলেন ‘তোমরা আমাকে রক্ত চাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ তেমনি বঙ্গবন্ধুও বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব’। আবার মহাত্ম গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শের বার্তা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, স্বরাজ আর রিম্যুভাল অব আনটাচেবিলিটি ও গ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। নেতাজী এবং গান্ধীর আদর্শ গ্রহণ করে তাঁদের যেসব ব্যার্থতা ছিল তা এড়িয়ে বাঙালিদের মুক্তির পথ নির্ধারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

                                      

বাঙালি নানাভাবে শুধু শোষিতই হয়েছে। জনম দুখী বাঙালির ভাগ্য নির্ধারণের ভার বাঙালির কাছে ছিল না। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো। এক হাজার মাইনের ব্যাবধানে দুই পাকিস্তানে মাত্র ৭% লোকের ভাষা উর্দুকে ৫৪% বাংলা ভাষাভাষি জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সংগ্রাম পরিষদের অনেক নেতা আপস করার অভিপ্রায়ে দোদুল্যমানতায় ভুগছিলেন তখন শেখ মুজিব ১০ মার্চ ১৯৪৮ সালে ঘোষণা করেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম চলবে প্রবলভাবে। ১১ মার্চ ১৯৪৮ এ গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিব। শেখ মুজিব ১৫ মার্চ জেল থেকে মুক্তি পেলেও ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবার তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি বন্দী মুক্তির দাবীতে কারাগারের অভ্যন্তরে আমরণ অনশন শুরু করলে উত্তেজনা কমাতে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ১৮ ফেব্রæয়ারি ফরিদপুরের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। শেখ মুজিবকে ফরিদপুরে নেয়ার সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেন যেন একুশে ফেব্রæয়ারিতে হরতাল মিছিল শেষে আইন সভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে স্বাক্ষর আদায় করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচ বারে ১০১৪ দিন কারাভোগ করেন। ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা, তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন, তাই তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রাথমিক পর্বটি অর্জন করলেন। দেশভাগের পর বাঙালির প্রত্যেকটি অধিকার আদায়ের অগ্রভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে আন্দোলনে জড়িত হওয়ার কারণে শেখ মুজিবকে মুচলেকা দিতে বলা হলে তিনি তা কখনোই করেননি। শেখ মুজিব ছিলেন নীতিতে আপসহীন।

বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন অর্থাৎ প্রায় ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য একজন মানবতাবাদী নেতা ২৩ বছর রাজনৈতিক জীবনের জন্য ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘কোন জেল জুলুম কোন দিন আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু মানুষের ভালবাসা আমাকে বিবৃত করে তুলেছে।’ তিনি ছিলেন মানুষের ভালবাসার বাঙালি। বাঙালির অধিকার আদায়ের আপসহীন নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় গুণের কারণে খুব অল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলীম লীগের কনভেনশনে ২৯ বছর বয়সের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেই যুগ্ম সম্পাদক ০৮ মার্চ ১৯৫৪ সালের যুক্তফন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কৃষি ও বনমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের ক্ষুরধর নেতৃত্বে অতি দ্রæত তীক্ষœ হতে থাকে। তাঁর নেতৃত্বের কারণে ১৯৫৪ থেকে পরবর্তী বছরগুলো অর্থাৎ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদের উত্তরণ ঘটে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের প্রথম আন্দোলনের মাধ্যমে একমঞ্চে নিয়ে আসে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ৬ দফা। অর্থাৎ ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে তাঁর উত্থাপিত ৬ দফাই বাঙালি জাতির জন্য ম্যাগনাকার্টা হিসেবে সামনে আসে। যার পরিণতি ১৯৬৯ সালে ১১-দফা ভিত্তিক গণঅভ্যত্থান, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি থেকে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের নয়নের মনি। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আসনের মধ্যে ১৬৭টি। আর পশ্চিম পাকিস্তানের পিপল্্স পার্টিও নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর দখলে আসে ৮৮টি আসন। কিন্তু পাকিস্তানের জান্তা সরকার নানা বাহানা করতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সাধারণ পরিষদের ফয়সালা হওয়ার কথা। পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে দেয়। এর আগে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ১৯ মিনিটের এ যাদুকরি ভাষণ শোনার পর লক্ষ লক্ষ জনতাকে আবেগে উদ্বেলিত করে তুলছিলেন। বাংলার জনগণ শত শত বছর ধরে স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছে তা বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার পর ৭ কোটি বাঙালি স্বাধীনতা লাভের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিয়েছিল। নিরস্ত্র বাঙালি কেমন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে তা বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণভাবে বাতলে দিয়েছিলেন এভাবে-“তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ”

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল বিচক্ষণ কৌসুলীর মতো সুনিপুন উপস্থাপন। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষে এমনভাবে স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করলেন যাতে ঘোষণার কিছু বাকীও থাকল না। অপরদিকে তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানের জান্তা সরকারের সহজ ছিল না। লন্ডল থেকে প্রকাশিত ‘ঞযব উধরষু ঞবষবমৎধঢ়য’ পত্রিকার সাংবাদিক উধারফ খড়ংযধশ ১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকা থেকে প্রেরিত ‘ঞযব বহফ  ড়ভ ঃযব ড়ষফ চধশরংঃধহ’ শিরোনামে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন “ঙহ ঝঁহফধু (৭ গধৎপয ১৯৭১) ঝযবরশয গঁলঁন, পধসব ধং যবধৎ ঃড় ফবপষধৎরহম রহারঃরহম রসসবফরধঃব যধৎংয ৎবধপঃরড়হ ভৎড়স ঃযব অৎসু.” আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ ভাষণ, দাসপ্রথা বিলুপ্তির লক্ষে ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণ এবং দুই হাজার বছর আগে আলেকজান্ডারের পিতা ফিলিপের হাতে গ্রীক নগরী ধ্বংস হচ্ছিল তখন ডেমেস্থিনিস নাগরিকদের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, প্রত্যেকটি ছিল ঐতিহাসিক কিন্তু এসবই ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ছিল রেসকোর্সে তৈরী একটি মহাকবিতা। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় :
একটি কবিতা লেখা হবে
তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উম্মও অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
গণসূর্যের মঞ্চ ঝাঁপিয়ে কবি
শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানকে বঙ্গবন্ধু বাংলার ছাপ্পান্ন বর্গমাইল ধরে ৭ কোটি জনতার অভিব্যক্তিকে দৃশ্যমান ধরে অতীত, বর্তমান ও ভবিষতকে সামনে এনে প্রমিত বাংলাকে এড়িয়ে মানুষের মুখের ভাষার মনের কথা তুলে ধরে প্রমাণ করেছিলেন তিনি মানুষের কাছে কতটা আপনজন।

গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোনাল্ড রিগান পর্যন্ত ২৫০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ‘ঔধপড়ন ঋ ভরবষফ, ডব ঝযধষষ ঋরমযঃ ড়হ ঃযব ইবধপযবং: ঞযব ঝঢ়ববপযবং ঃযধঃ ওহংঢ়রৎবফ ঐরংঃড়ৎু’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ লিখেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত। এতে আলেকডান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অলিভার ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপোলিয়ান বোনাপূটি, যোসেফে গ্যালিবোল্ডি, আব্রাহাম লিংকন, ভøাদিমির লেনিন, উইড্রো উইলসন, উইনস্টন চার্চিল, ফ্রাঙ্কলিন, রুজভেল্ট, চালর্স দ্য গল, মাওসেতুং, হো সি মিন প্রমূখের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ভাষণ পর্যবেক্ষণ করে ইউনেস্কো তাদের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়াল্ড’ কর্মসূচীর আওতায় ২০১৭ সালের ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর প্যারিসে দ্বিবার্ষিক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ডকমেন্টারী হেরেটিজ’ মেমোরি অব দ্য ওয়াল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ এ অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এ সুপাশি সম্মতি দিয়ে ১৫ সদস্যের নির্বাহী পরিষদে পাঠিয়ে দেওয়ার দুইদিন পরই ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি ৪২৭তম ‘প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়াল্ড’ রেজিস্টারে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের আদর্শ নন। তিনি এখন সারা বিশ্বের জন্য উদাহরণ। ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল মানুষের উৎসর্গিত। বৃটিশ সাংবাদিক উধারফ ঋৎড়ংঃ এর প্রশ্ন দযিধঃ রং ুড়ঁৎ য়ঁধষরভরপধঃরড়হ? এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব. পরের প্রশ্ন ‘যিধঃ রং ুড়ঁৎ ফরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ ?’ এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ও ষড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয’ প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের মতে, ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।’ নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেয়া হয়। ‘পয়েন্ট অব পলিটিক্স হিসেবে। বৃটিশ লর্ড ফেনার ব্রেকওয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।

কিউবার লৌহমানব ফিদেল কাস্ট্রোর বিখ্যাত যে উক্তি এখনো বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়।’ আবার বঙ্গবন্ধুর কোমল হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায় সফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ইয়াসির আরাফাতের কথায় “আপোসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।”

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালের ০৬ জুন বাংলাদেশ সফরকালে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একজন বড় মাপের নেতা, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।’ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরকালে বলেন, ‘ও ংধষঁঃব ঃযব নৎধাব ষবধফবৎ ড়ভ ধষষ ঃরসবং.’ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরকালে বলেন, বঙ্গবন্ধু বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছে। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধু নন তিনি ভুটানেরও বন্ধু। ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বাংলাদেশ ভ্রমণকালে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হলেন এশিয়ার মহান নেতা।’

বাংলাদেশের চিরবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বের মানবতার প্রতীক। তা আজ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ঋৎরবহফং ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ’ বা বিশ্ববন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে কূটনৈতিকরা। জাতিসংঘে বিশ্ববন্ধু স্বীকৃতির অনুষ্ঠানে ছিলেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবর উদ্দীন, জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি আনোয়ারুল করিম চৌধুরী, ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ এইচ মনসুর, কিউবার রাষ্ট্রদূত এনা সিলভিয়া রদ্রিগেজ আবাসকাল, জাতিসংঘে সার্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিলান মিলানোভিচ এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি (বর্তমানে পররাষ্ট্র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন।

বিশ্ববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা পুরুষ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতকালে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলেন ১৭ মার্চের মধ্যে। ইন্দিরা গান্ধী সাদরে গ্রহণ করেন শেখ মুজিবের সেই প্রস্তাব এবং তিনি জানান, ‘আপনার শুভদিনে আমাদের ভারতীয় সৈন্য আপনার স্বাধীন দেশ থেকে প্রত্যাহার করে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে চাই’।  

বিশ্বের যেকোন স্থানে বঙ্গবন্ধ উপস্থিত থাকলে তিনিই থাকতেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে সকলের দৃষ্টি কাড়তেন। তাঁর ক্যারিসম্যাটিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ১৯৭৩ সালে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্ববন্ধু’ বলে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু আজ বিশেষ কোন দলের বা অঞ্চলের নেতা নন, তিনি হলেন মানবতার নেতা। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা। আজকে বিশ্বে যে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন চলছে, তা থেকে পরিত্রানের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উপস্থিতি বড় প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দী তখন কলকাতায় এক প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে কবি ও বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে উপস্থিতি না থাকতে পেরে রাতে বাড়িতে ফেরে লেখেন,
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ অশ্রæগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়
হবে হবে জয়
জয় শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ মূল্যায়নে লক্ষে শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান কর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে শুধু বঙ্গবন্ধু হননি, হয়েছেন বিশ্বনেতা’। বর্তমানে বিশ্বনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, জাতিয়তাবোধ, নন্দনবোধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধাচারণ ও সত্যের অবগাহনের উপস্থিতি বিশ্বের খুব প্রয়োজন।

 

লেখক:  ড. মোঃ মোফাকখারুল ইকবাল

প্রথম সচিব (প্রেস),

বাংলাদেশ উপ-হাই কমিশন, কলকাতা

উপরে