আমাদের স্কুলের শারাফাত স্যার
কয়েকদিন ধরেই শারাফাত স্যারের কথা মনে পড়ছে। আমাদের স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। অসাধারণ জ্ঞানী একজন মানুষ।
আমাদের ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত প্রতিটা ক্লাসের ইংরেজি সাবজেক্ট পড়াতেন। কখনো ইংরেজি প্রথম পত্র, কখনো ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র। স্যার, ক্লাসে চিল্লাপাল্লা দেখলে মাঝে মধ্যে একটা বড় বেত নিয়ে আসতেন। টেবিলের উপর বাড়ি দিতেন। কিন্তু কখনো কাউকে মারতেন না। তবে আমরা স্যারকে খুব ভয় পেতাম। আমাদের এসএসসি পরীক্ষা সময়ই স্যার অবসরে চলে গিয়েছিলেন।
যাই হোক, আমি ইংরেজি গ্র্যামার স্যারের কাছ থেকেই শিখে ছিলাম। এখনও যখন ইংরেজি দুইটা লাইন লিখি, কিভাবে ভাল লেখা যায়, স্যারের কথাগুলো মনে পড়ে। ইংরেজিতে শুদ্ধ বাক্য গঠনের নিয়মগুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন।
ক্লাস সিক্স, সেভেনে থাকতে স্যার একটা কথা আমাকে বলতেন। অংকের শিক্ষকের ছেলে শুধু অংকে ভালো হলে হবে না। ইংরেজিতেও ভালো হতে হবে। ক্লাসে এই কথাটা শুনতে আমার বেশ লজ্জা লাগত।
আমি স্যারের কাছে ক্লাস এইট থেকে প্রাইভেট পড়তাম। ছোট হবার কারণে সিক্স, সেভেনের ব্যাচ স্যার পড়াতেন না।
ক্লাস নাইনের প্রায় শেষের দিকে একদিন প্রাইভেট পড়ার সময় স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অন্য সাবজেক্টের কি অবস্থা?
আমি: বাংলা সেকেন্ড পেপারের গ্র্যামারে সমস্যা আছে। সমাস, বাচ্য পরিবর্তন, কারক বিভক্তি, ধ্বনি পরিবর্তন এগুলো শুধু ভুল হয়।
স্যার: ব্যাকরণ কী মুখস্ত করো?
আমি: জ্বী স্যার।
এগুলো মুখস্ত করলে তো পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাবে না। কাল থেকে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বোর্ডের বইটা নিয়ে আসবে। আমাদের স্কুলের স্যাররা সপ্তাহের ৬ দিনই পড়াতেন। শুধু শুক্রবার ছুটি।
ব্যাচের অন্যরা যখন ইংরেজি প্যারাগ্রাফ কিংবা কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখে, স্যার তখন আমাকে বাংলা ব্যাকরণ বুঝিয়ে দিতেন। একটা সময় দেখলাম, আমি ব্যাকরণ পারছি।
ক্লাস নাইনের প্রথম, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় আমি বাংলা সেকেন্ড পেপারের এমসিকিউ'তে ২৫/২৭ এরকম নম্বর পেতাম। ক্লাস টেনে ইমপ্রুভ হল।
এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের অবজেক্টিভে ৪৫ পেয়েছিলাম। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের অবজেক্টিভেও ৪৫ পেয়েছিলাম। আসলে আমাদের শারাফাত স্যার, ইংরেজি এবং বাংলা ব্যাকরণ দুটিতেই পন্ডিত ছিলেন।
একদিন প্রাইভেট পড়ানোর সময় স্যার আমাদের বলছিলেন, দেখতে দেখতে তোমরাও একসময় বড় হয়ে যাবে। অনেকেই অনেক জায়গায় চাকরি করবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে কিন্তু যে যেখানেই যাও, এই রেলওয়ে এলাকা, রেলের মাঠ, স্টেশন, লঞ্চঘাট, বড়বাজার, স্কুল, নিক্সন মার্কেট এগুলো কখনো ভুলতে পারবে না। কথাগুলো তখন বুঝতে পারি নাই। এখন বুঝি।
আমাদের শারাফাত স্যার অত্যন্ত আল্লাহ ভীরু, দ্বীনদার একজন মানুষ ছিলেন। রাস্তায় যখন হাঁটতেন, সব সময় মাথা নীচু করে হাঁটতেন।চলনে-বলনে-কথা-বার্তায় একজন পরিপূর্ণ নেককার মানুষ। স্যারের সন্তানরা সবাই কোরআনে হাফেজ ছিলেন।
২০০৭ সালে স্যার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমি আর আব্বা দেখতে গিয়েছিলাম। স্যালাইন চলছিল। স্যার গভীর ঘুমে মগ্ন। কথা হলো না। দুইদিন পরেই শুনলাম, স্যার মারা গেছেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো মানুষরা হয়ত এভাবেই চলে যায়।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।