দেশে ফিনটেক প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার জরুরি
মো. আফজাল করিম:
আর্থিক খাত যে কোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিতে আর্থিক খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের চারপাশ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে আরও বেশকিছু পরিবর্তনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিবর্তনগুলো হতে পারে প্রযুক্তিগত কিংবা প্রক্রিয়াগত।
দ্য গ্লোবাল ফিনটেক ইনডেক্স ২০২০-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক প্রতিটি শিল্পের জিডিপির শতকরা ৬০ ভাগ ডিজিটায়িত হবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এ রকমই একটি বহুল প্রচলিত উন্নত প্রযুক্তি হচ্ছে ফিনটেক। আর্থিক খাতের মান উন্নয়নে বাংলাদেশের জন্যও ফিনটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রচলিত ও সনাতন আর্থিক সেবাগুলোকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যতিক্রম ও সুবিধাজনকভাবে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে ফিনটেক প্রযুক্তি। তাই ফিনটেককে মূলত ইন্টারনেট, অ্যাপ্লিকেশনের এক সমন্বিত প্রক্রিয়া বা ব্যবসায়িক মডেল বলা যায়।
ফিনটেক হল বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতির চমক, যা আর্থিক খাতে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন সৃষ্টি করে বিশ্বময় অভূতপূর্ব উন্নতির আলোকিত পথ দেখাচ্ছে। ফিনটেক প্রযুক্তি যে কোনো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে করেছে আগের থেকে সহজতর আর আর্থিক সেবাকে করে তুলেছে সবার কাছে সহজলভ্য। এতে করে সব পর্যায়ের গ্রাহক যেমন আর্থিক সেবা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, পাশাপাশি গতানুগতিক সেবাগুলোও হয়েছে উপভোগ্য।
বৈশ্বিকভাবেই তাই ফিনটেক প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগও বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে এ শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ১২.২০ বিলিয়ন ডলার; সেখানে ২০১৮ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২৫০টি ফিনটেক সংস্থার ক্ষেত্রেই এর পরিমাণ ছিল ৩১.৮৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এছাড়া কেপিএমজির ২০১৮ ফিনটেক পালসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে ফিনটেক বিনিয়োগ ২০১৭ সালে ৫০.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৮ সালে ১১১.৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে ফিনটেক অত্যন্ত কার্যক্ষম বিধায় এ প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক কার্যক্রমে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হয়েছে। কোর ব্যাংকিং সলিউশন, এটিএম, পজ ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি আধুনিক সেবার মাধ্যমে লেনদেনের তথ্যসহ হিসাবসংক্রান্ত নানা বিষয়ে গ্রাহকরা সার্বক্ষণিক অবগত থাকে বিধায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গ্রাহক পর্যায়ে সন্তুষ্টি অর্জন করাও সম্ভব হয়েছে।
ফলে আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এসেছে এবং গ্রাহক হয়রানি কমিয়ে অধিকতর আস্থা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সামগ্রিকভাবে ফিনটেকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সহজতর হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও পরিচালন ব্যয় হ্রাস করে অধিকতর সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে ব্যাপকহারে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস বা ওয়ালেট ব্যাংকিং চালু হয়েছে, যা আদতে ফিনটেক সেবা। প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার ধারণা পালটে দিয়ে শহর-গ্রামের কোটি কোটি মানুষকে আধুনিক আর্থিক সেবার আওতায় আনা গিয়েছে। যে মানুষটি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অভাবে কোনোরূপ লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি, সে এখন খুব সহজেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারছেন।
পাশাপাশি নগদ টাকা বহনের ঝুঁকিও হ্রাস পেয়েছে বহুলাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে কেবল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই এ খাতে মার্চেন্ট পেমেন্ট বাবদ ৬০৫.৮৯ কোটি এবং ইউটিলিটি বিল বাবদ ৩১২.৮৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
তাই দেশে দিন দিন এ সেবার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। ফিনটেক ব্যাংকিং সেবাকে গণমানুষের একেবারে হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে। করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ ডিজিটাল লেনদেন ও ই-কমার্সে আকৃষ্ট হয়ে অধিকহারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি পরিশোধ হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অনেকে অনলাইনে কেনাকাটা করছেন। ডিজিটাল ব্যবসায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে অবকাঠামো সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা সরকার দিয়ে যাচ্ছে।
সরকার আমাদের দেশে প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিয়ে থাকে, যা বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এছাড়া বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে ইঅঈঐ, ইঊঋঞঘ, জঞঝে, ঝডওঋঞ ইত্যাদি ফিনটেক সেবার বহুল প্রচলন হয়েছে।
টাকাকে দৃশ্যমান না করেই সারা দেশে আর্থিক প্রবাহ চালু করা সম্ভব হয়েছে ফিনটেকের মাধ্যমেই। এমনকি হালের রাইড শেয়ার অ্যাপ, অনলাইন শপ, ফুড ডেলিভারি অ্যাপ ইত্যাদি ফিনটেক প্রযুক্তিরই উদাহরণ।
ফিনটেকের আরও একটি উদ্ভাবন হচ্ছে বিটকয়েন। বিটকয়েন হচ্ছে এক ধরনের ক্রিপ্টো-কারেন্সি কিংবা ডিজিটাল কারেন্সি। এ প্রযুক্তি ওয়েব ও ইন্টারনেটের চেয়েও বেশি সম্ভাবনাময় একটি প্রযুক্তি ও প্লাটফর্ম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনলাইনে লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো আপাতদৃষ্টিতে কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই মিটিয়ে ফেলা যাচ্ছে ক্রিপ্টো-কারেন্সির মাধ্যমে।
ফিনটেকের ধারণাটি উন্নত বিশ্বে বহুল প্রচলিত হলেও আমাদের জন্য একটি নতুন বিষয়। কিন্তু এ খাতের অপরিসীম সম্ভাবনার দিকগুলো বিবেচনা করলে আমাদের মতো দেশগুলোতে এর প্রয়োগ অধিকতর প্রযোজ্য। তাই দেশের সর্বসাধারণকে আর্থিক সেবাগুলোর সঙ্গে আত্তীকরণ করতে হলে ফিনটেক প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার জরুরি।
এ জন্য আরও বিস্তৃত পরিসরে ফিনটেক প্রযুক্তি চালু করতে হবে এবং আইটি কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মীদের নিয়মিতভাবে সাইবার সিকিউরিটি, ব্যাংকিং সফটওয়ার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশের সম্ভাবনাময় ও উদ্ভাবনী তরুণ গোষ্ঠীকে এ প্রযুক্তির সঙ্গে একীভূত করতে হবে। বিষয়টি কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রতিটি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফিনটেক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সেমিনার, প্যানেল আলোচনা, ইনসাইট সেশন, কেস স্টাডি প্রেজেন্টেশনের আয়োজন করতে হবে।
গ্রামবাংলার গণমানুষের কাছে এ প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ে বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতির এ খাতে গুরুত্বারোপ করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের এখনই উপযুক্ত সময়।
লেখক: ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সোনালী ব্যাংক লি.