খাদ্য উৎপাদনে পঞ্চাশ বছরে কতটা এগিয়েছে দেশ
আবদুল লতিফ মন্ডল:
আর ক’দিন পরই আমরা উদযাপন করতে যাচ্ছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে মৌলিক চাহিদাগুলোর শীর্ষে থাকা খাদ্য উৎপাদনে আমরা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছি, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে শর্করা (চাল, গম, আলু), আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম, ডাল), স্নেহ পদার্থ (ভোজ্যতেল, দুগ্ধজাতীয় খাবার), মিনারেলস (শাকসবজি), মসলা (পেঁয়াজ, রসুন, আদা) এবং পানীয় (চা, কফি)।
তবে বাংলাদেশে খাদ্য বলতে মূলত চাল বা চাল থেকে তৈরি ভাতকে বোঝায়। এর কারণ, এ দেশের কমবেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। শুধু তাই নয়, চাল দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
অতীতে কোনো সরকারই চায়নি এবং বর্তমান সরকারও চায় না দেশে চালের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিক এবং পণ্যটির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে যাক। চালের অভাব ও উচ্চমূল্যের কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য ফ্যাক্টরের সঙ্গে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করার নজির রয়েছে।
এখন দেখা যাক সার্বিক খাদ্য উৎপাদনে আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে। তবে এ বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার তা হলো, স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) থেকে সদ্যসমাপ্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৫-২০) এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনার (২০১০-২০) উদ্দেশ্যাবলি, বাস্তবায়ন কৌশল এবং গত পাঁচ দশকে বার্ষিক বাজেটে কৃষি খাতে অর্থ বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। খাদ্য উৎপাদন নিয়ে আলোচনায় প্রথমে আসে আমাদের প্রধান খাদ্য চালের বিষয়টি। স্বাধীনতা লাভের সময় দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কমবেশি ১ কোটি টন, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টনে। অর্থাৎ স্বাধীনতাকালীন দেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা দ্বিগুণের কিছুটা বেশি বৃদ্ধি পেলেও চালের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি।
আলু উৎপাদনে দেশ শুধু স্বনির্ভর নয়, বরং দেশের চাহিদা মিটিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে তা রপ্তানি করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশে ১ কোটি টনের বেশি উন্নত মানের আলু উৎপাদিত হয়েছে, যখন দেশে পণ্যটির চাহিদা ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম।
খাদ্যে পুষ্টিমাণ বৃদ্ধিতে আমিষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমিষের প্রধান উৎস মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে (অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্ততা ২০২০-২১)। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ৩য় স্থান এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান অধিকার করেছে।
মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৬৮ লাখ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪ হাজার ৩০৯ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে।
মৎস্য খাতের তুলনায় প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়, যদিও বাংলাদেশে গরুর উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে, তবুও দুধ ও মাংসের উৎপাদন চাহিদা মেটানোর জন্য অপর্যাপ্ত। দুধ ও মাংসের ঘাটতি যথাক্রমে ৫৭ ও ৩৭ শতাংশ বলে অনুমিত হয়। তাছাড়া পোলট্রি থেকে ডিম প্রাপ্যতার ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে।
তবে সপ্তম বার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে গবাদি প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, প্রতিষেধক টিকা ও চিকিৎসা প্রদানে উন্নতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম এ খাতে সাফল্য বয়ে এনেছে। মাংস উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে বলে অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্ততায় দাবি করেছেন। তাছাড়া, ডিম ও দুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
সবজি উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। এফএও’র তথ্যমতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এফএও এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) সূত্রের বরাত দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম, যা গত বছরে দাঁড়িয়েছে ৭০ গ্রামে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সবজি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
তবে বেশ কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনে দেশ পিছিয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গম, ডাল, ভোজ্যতেল, দুধ, চিনি, ফল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানি মাধ্যমে এগুলোর চাহিদা পূরণ করতে হয়। তাছাড়া উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাবে সময়ে সময়ে প্রধান খাদ্যশস্য চালও আমদানি করতে হয়।
খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে খাদ্যশস্য (চাল, গম) উৎপাদনে বাংলাদেশকে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন উপর্যুপরি বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস। প্রধান খাদ্যশস্য চালের উৎপাদন স্বাধীনতা লাভের সময়ের তুলনায় তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেলেও প্রবৃদ্ধি হারে ধারাবাহিকতার অভাবে মোট উৎপাদন দেশের চাহিদা মেটাতে না পারায় পণ্যটি আমদানি করতে হচ্ছে। গত পাঁচ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হারের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সামীক্ষা এবং অন্যান্য রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন। এর আগের অর্থবছরে (২০১৪-১৫) একই পরিমাণ চাল উৎপাদিত হওয়ায় চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে বৃহত্তর সিলেটের হাওড়াঞ্চলে আগাম বন্যায় বোরো ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৮ লাখ টনে। অর্থাৎ এ অর্থবছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। দেশে চালের চাহিদা মেটাতে ওই অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টনে। এ অর্থবছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল অতি উৎসাহব্যঞ্জক- ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির ছিল ইতিবাচক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে দাঁড়ায় বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দাবি করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএস ডিএ) হিসাবে দেখা যায়, ওই অর্থবছরে দেশে মোট ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক।
অতি খরায় আউশের এবং উপর্যুপরি বন্যায় আমনের উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চলতি অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৯৬ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টনে দাঁড়াবে বলে ইউএসডিএ’র এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ উৎপাদন আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১০ লাখ টন কম। একটি দৈনিকের (বণিক বার্তা, ১ মার্চ) হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশে চালের চাহিদা থাকবে প্রায় ৩ কোটি ৫৯ লাখ টন। সে হিসাবে দেশে এ অর্থবছর চালের ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১১ লাখ টনে, যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে।
খাদ্যশস্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গমের উৎপাদন মোটেই সন্তোষজনক নয়। সরকারি তথ্য মোতাবেক ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন দাঁড়িয়েছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টনে, আর এখন তা ১২-১৩ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে শীতের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব হ্রাস, গম ফসলে মারাত্মক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ ইত্যাদি কারণে একরপ্রতি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ায় গম চাষে কৃষকের কিছুটা অনীহা দেখা দেওয়ায় দেশে গমের উৎপাদন ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে।
চাহিদার তুলনায় পণ্যটির উৎপাদনের পরিমাণ পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে আসায় দেশ গমে প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি অর্থবছরে দেশে ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন দাঁড়ায় ১২ লাখ টনের সামান্য বেশি। অর্থাৎ দেশের চাহিদা মেটাতে এ বছর ৬৩ লাখ টনের কিছুটা বেশি গম আমদানি করতে হবে।
এদিকে খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্যের পর্যাপ্ততা, গুণগতমানসহ নিরাপদ খাদ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও সক্ষমতা- এ চারটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তৈরি দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স’ বা জিএফএস আই-২০২০ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের সামান্য অবনমন হয়েছে। ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ৮৩তম।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের খাদ্য উৎপাদনে বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। খাদ্য উৎপাদনে সঠিক তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাবিদরা সঠিক কার্যক্রম গ্রহণে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ সময়ে খাদ্যশস্যসহ খাদ্যের অন্য যেসব উপাদানে আমাদের উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় কম, সেগুলোতে উৎপাদন বাড়িয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রত্যয় ব্যক্ত করি।
লেখক : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক