কোনো পেশাই ছোট নয় । আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে একে অপরকে ছাড়া কখনোই কেউ পরিপূর্ণ হতে পারে না। এখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পরস্পরের সহায়ক, বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাই কোনো পেশাকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কাজকে যদি ভালোবেসে নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়, তাহলে সব কাজই সম্মানজনক। কারণ প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখেন।
বলা বাহুল্য, প্রায় সব ক্ষেত্রেই পেশার সঙ্গে পেশার, পেশাজীবীর সঙ্গে পেশাজীবীর নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে, অর্থাৎ একটি ছাড়া অন্যটি অচল। সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পর্ক গভীর হয়েছে। একটি দালান শুধু ইট-বালি দিয়েই নির্মাণ করা যায় না; সিমেন্ট, রড, শ্রম, অর্থসহ অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়। একটি অফিস শুধু ম্যানেজার একাই পরিচালনা করতে পারেন না, অন্যান্য সহকর্মীরও দরকার হয়। ছোট একটি বাসেও যেমন ড্রাইভারের পাশাপাশি হেলপার ও কন্ডাক্টরের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি একটি দেশ পরিপূর্ণ হতে হাজারো পেশার মানুষের প্রয়োজন হয়।
বিশ্বে অনেক মনীষী ছিলেন সাধারণ পেশাজীবী পরিবারের সন্তান। কৃষক, মুচি, ঝাড়ুদার ও সমাজের ক্ষুদ্র পেশা থেকে প্রেসিডেন্ট, বিশ্ববিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন-এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নয় বছর বয়সে তার মাকে হারান। খুব অল্প বয়সেই দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেন। কখনো নৌকা চালিয়ে, আবার কখনো কাঠ কেটেও সংসার চালিয়েছেন তিনি। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের অতীতে শরবত বিক্রি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চা বিক্রি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর ফার্নিচারের দোকানের কর্মচারী থাকা, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বাস চালানো, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের খেতমজুরের কাজ ইত্যাদির কথা সবারই জানা।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, যা সব পেশা ও মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ সময়ের প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে আমাদের দেশের সব পেশাজীবী মানুষেরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সব পেশার মানুষের চাহিদা, চাওয়া ও পাওয়া ছিল অভিন্ন। এসব বিবেচনায়ও কোনো পেশা ও মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ নেই।
জীবিকা অন্বেষণের সাধনায় কোনো পেশাই ছোট নয়। বৈধ উপায়ে আত্মকর্মসংস্থানের নির্দেশ দিয়ে মহান স্রষ্টা বলেন, ‘সালাত সম্পন্ন হলে তোমরা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ো। আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো (সূরা জুমআ, আয়াত-১০)। আল্লাহ্ আরও বলেন, ‘তোমাদের উপার্জিত পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৬৭)। যুগে যুগে সব নবি-রাসূলেরই কোনো না কোনো পেশা ছিল, তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতেন না। কোনো কাজকেই ছোট করে দেখতেন না।
আমার বাবা সরকারি চাকরিকালে একটি ছেলেকে খুঁজে পেয়েছিলেন; ধরা যাক তার নাম ছিল ‘মাসুদ’ (প্রকৃত নাম নয়)। সে মূলত গলায় ঝুলিয়ে বাক্সে করে পান-সিগারেট বিক্রি করত। ১১-১২ বছর বয়সে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে কখনোই তার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আমাদের দুই ভাইয়ের লেখাপড়ায় সেও একটু একটু লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। মাসুদকে তখন বই, খাতা, হোয়াইট বোর্ড, মার্কার পেনসিল কিনে দেই। আমাদের নিজ নিজ ক্লাস, প্রাইভেট পড়া এবং টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে তাকে টুকটাক লেখাপড়া করাই। দুই-তিন মাস বাদে সে নিজের নাম-ঠিকানা লিখতে শেখে এবং পত্রিকার হেডলাইন পড়তে শেখে।
এক সময় সে তার সবকিছু নিয়ে নিজের বাড়িতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এরপর অনেকদিন তার আর কোনো খোঁজ পাইনি। একদিন হঠাৎ আমার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন আসে এবং অপর প্রান্ত থেকে বলে ‘ভাইয়া, আমি মাসুদ’। সে কোথায় জানতে চাইলে আমার অফিসের সামনে আছে বলে জানায়। ঢাকার তেজগাঁও থেকে ট্রাক নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিল।
ফেরার পথে কুমিল্লা বিশ্বরোডে গাড়ি রেখে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দীর্ঘ প্রায় একযুগ পর দেখা। ভারী ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া ট্রাক চালায় বলে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে ফরম ডাউনলোড করে মাসুদকে দেই। এরপর সে চলে যায়। গাজীপুর মেট্রোপলিটনে চাকরি করতে এসে মাসুদকে আবার খুঁজে পাই এবং ছোট গাড়িতে কাজের সুযোগ করে দেই।
ঢাকায় চাকরিকালে আমার বাসার নিচে এক দারোয়ান দম্পতি থাকত। দারোয়ান সফিক (প্রকৃত নাম নয়) বয়সে আমার থেকে ছোটই হবে। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সবাই অনেক ছোট ছিল। ওদের বই, খাতা, পেনসিল, স্কুলব্যাগ, স্কুলড্রেস, জুতা ও অন্যান্য খাবার-দাবার কিনে দিতাম। আমাদের বিল্ডিংয়ে আট-দশটা পরিবার থাকত।
সেখানে দারোয়ান হিসাবে মাসে বেতন পেত, আবার টুকিটাকি হাতখরচ অনেকেই দিত। তার স্ত্রী কয়েকটা বাসায় গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করত। নিচতলায় গ্যারেজের পাশে একটা কক্ষে থাকত, ভাড়ারও প্রয়োজন হতো না। সফিক লেখাপড়া জানত না। তার সন্তানের সঙ্গে তাকেও একটু-আধটু পড়তে, লিখতে উৎসাহ দিলাম। কিছুদিন পর সে নিজের নাম-ঠিকানা লিখতে এবং অল্প অল্প পড়তে শেখে। তার জন্য ভালো কিছু করে দেওয়ার চিন্তা করি। কিন্তু কোথায় চাকরি দেব, প্রতিযোগিতার যুগে সার্টিফিকেট ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই সফিকের নেই।
তবে সে মারাত্মক কায়িক শ্রম দিতে পারে। তখন ট্রাফিক বিভাগে কাজ করার সুবাদে তাকে ড্রাইভিং শেখায় আগ্রহী করে তুললাম। দারোয়ানের কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুব ভোরে গিয়ে ড্রাইভিং শেখে। যথারীতি ড্রাইভিং পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে লাইসেন্স হাতে পায় সে। সফিক তখন আরও ভালো কিছুর আশায় দারোয়ানের চাকরি ছেড়ে পাশেই বস্তিতে বাসা ভাড়া নেয়। ফাঁকে ফাঁকে ছোট পিকআপ গাড়ি চালায় এবং তার স্ত্রী কয়েকটা বাসায় কাজ করে।
গাজীপুরে চাকরি করতে এসে পরিচয় হয়েছে করিমের (প্রকৃত নাম নয়) সঙ্গে; বয়স ১১-১২ হবে। মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বের হয়েছে। মাঝেমধ্যে লোকাল বাস সার্ভিসে হেলপার (চালকের সহকারী) হিসাবেও কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরা করিমকে নিয়ে এসেছে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে। একে তো শিশু, তার ওপর অটোরিকশা নিয়ে মহাসড়কে।
করিমের সংসারে বাবা নেই, অনেক আগেই ওদের ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছে। ওর মা আবার বিয়ে করেছে। কিন্তু সেখানেও সৎবাবা ঠিকমতো সংসারে খেয়াল রাখে না। মাকে মারধর করে অন্য কোথাও চলে গেছে। ঘরে মা অসুস্থ, তার ওপর ছোট এক ভাই। মালিকের দুইশ টাকা জমা বকেয়া রেখে অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে নিতান্তই সংসার চালানোর জন্য, মায়ের ওষুধ কেনার জন্য।
করিমকে সংসারের কয়েকদিনের বাজার ও মালিকের জমা টাকাটা দিয়ে ঘরে পৌঁছে দেই। তার নিরাপদ জীবন ধারণের কথা বিবেচনা করে আমরা প্রয়োজনীয় মালামাল ও কিছু পুঁজি দিয়ে তার পরিবারকে একটা ছোট চায়ের দোকান করে দেই।
এমন অসংখ্য মাসুদ, সফিক, করিম আছে, যাদের বেড়ে ওঠা কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে চাকরির কারণে এ বিষয়ে আরও গভীরে দেখার সুযোগ হয়েছে। পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে দেখেছি, অনেকেই ছোটবেলায় বাবা-মা উভয়কেই কিংবা বাবা অথবা মাকে হারিয়েছে। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ তেমন একটা পায়নি। অনেক সময় ভিন্ন পরিবেশে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে অনাদর, অবহেলা আর অযত্নে বড় হতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিকমতো খাবারও পায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিতে কিংবা কাজ শিখে নিজের জীবন চালাতে অনেকটা বাধ্য হয়ে গ্যারেজে, ওয়ার্কশপে কাজ নিতে হয়েছে। কেবল নিজের জন্য নয়, অসুস্থ বাবা-মা কিংবা নির্ভরশীল ছোট ছোট ভাইবোনদের জন্যও এমনটা করতে হয়েছে। এভাবেই অনেকে কাজ করতে করতে হেলপার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে গণপরিবহণে কিংবা পণ্যপরিবহণে দায়িত্ব পালন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চালকের ভূমিকায় নিজেকে আবিষ্কার করে। একপর্যায়ে পেশাদার চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সহস্র মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিতপ্রাণ হিসাবে নিয়োজিত রাখে। চলার পথে কারও কারও ভূমিকা বিতর্কিত বা সমালোচিত হলেও তা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে এক ব্যক্তি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘মি. লিংকন, আপনার ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে আপনার বাবা আমার পরিবারের জন্য জুতা তৈরি করত।’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি খুব ভালো করেই জানি আমার পিতা আপনার পরিবারের জন্য জুতা তৈরি করতেন।
শুধু আপনার কেন, এখানে এ রকম অনেকেই আছেন, যাদের পরিবারের জন্য বাবা জুতা তৈরি করতেন। জুতা তৈরিতে তিনি ছিলেন একজন জিনিয়াস। তিনি এমন এক অদ্ভুত নির্মাতা ছিলেন যে আজ পর্যন্ত তার নির্মাণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি বা কেউ অভিযোগ করেনি। আপনার কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে বলুন, আমি আপনার জন্য আরেক জোড়া জুতা তৈরি করে দেব। আমি নিজেও জুতা বানাতে পারি।’ লিংকন আরও বলেন, কোনো কাজ ছোট নয়। ছোট সে, যে কাজকে ছোট ভেবে অহেতুক বিদ্রুপ করে।
ইরানি সাহিত্যিক ও দার্শনিক শেখ সাদী এক রাজার আমন্ত্রণে খুবই সাধারণ পোশাকে রাজদরবারে যাওয়ার পথে রাত হয়ে গেলে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। তার পোশাক দেখে তারা তাকে সাধারণ পেশার মানুষ মনে করে সাধারণ খাবার ও সাধারণভাবে থাকার ব্যবস্থা করেন। পরদিন রাজার কাছ থেকে বিভিন্ন উপঢৌকন ও দামি পোশাক-পরিচ্ছদ উপহার পেয়ে রাজকীয় হালে ফেরার পথে আবারও সেই বাড়িতে আশ্রয় নিলে তারা তাকে উচ্চমর্যাদার পেশাজীবী মনে করে ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন। এভাবে আমাদের সমাজেও অনেকে আছে, যারা পোশাক-পরিচ্ছদ ও পেশার মাপকাঠিতে ব্যক্তির মূল্যায়ন করে থাকে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
লেখক : উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক), গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ।